বাংলা ধনিয়া

ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম

সুগন্ধি বাংলা ধনিয়া বা বিলাতি ধনিয়া বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্যাঞ্চলের একটি অন্যতম অর্থকরী ফসল। অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত লাভজনক এ পাতাজাতীয় ফসলটির উচ্চ পুষ্টিমান, প্রখর সুগন্ধি ও উন্নত ভেষজ গুণের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় এর চাষাবাদ ও বিস্তৃতি দ্রুত বাড়ছে। ১৯৯৯ সালে সারা বিশ্বে এর মোট উপাদন প্রায় ১০ হাজার টন থেকে ২০০৮ সালে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় পাঁচ লাখ টনে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকার বাইরে এর পরিচিতি কম এবং ইংরেজি কোনো সুনির্দিষ্ট নাম না থাকায় এটি বিভিন্ন দেশে অন্তত ৭৩টি নামে পরিচিত। তবে অনেক দেশে এটাকে False Coriender নামে অভিহিত করা হয়। আবার ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এটাকে Eryngium বা Eryngo বলা হয়।

প্রখ্যাত হর্টিকালচারিস্ট ড. মামুনুর রশীদ তার সবজিবিজ্ঞান বইতে এটিকে বাংলা ধনিয়া নামে অভিহিত করেছেন। বিলাত থেকে না এলেও এটি সাধারণভাবে বিলাতি ধনিয়া হিসেবে আগে থেকেই পরিচিত। তবু যেহেতু এটি এ এলাকারই একটি ফসল, তাই একে বিলাতি ধনিয়ার পরিবর্তে বাংলা ধনিয়া বলাই যুক্তিসংগত।

ফসলটির উন্নয়ন ও উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র রাইখালী, চন্দ্রঘোনা, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ও থাইল্যান্ডের ক্যাসেটসার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর  বেশকিছু গবেষণা হয়েছে এবং আরো বিভিন্নজন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে গবেষণা চালাচ্ছেন।

ধনিয়ার পুষ্টিগুণ: ফসলটির পুষ্টি গুণাগুণ অত্যন্ত উচ্চমানের। এর পাতা ও কাণ্ডে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ক্যারোটিন ও রিবোফ্লাভিন রয়েছে। এ ধনিয়া থেকে উদ্বায়ী সুগন্ধি তেলজাতীয় পদার্থ ও অ্যাসিডজাতীয় উপাদান সংগ্রহ করে উচ্চমূল্যের সুগন্ধি ও ভেষজ ওষুধ তৈরি করা যায়। এ কারণে শিল্পক্ষেত্রেও এর চাহিদা যথেষ্ট।

নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি (মধ্য কার্তিক-মধ্য ফাল্গুন) বাংলা ধনিয়ার বীজ বপনের উত্তম সময়। মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে মার্চ পর্যন্ত বপন করা যায়। তবে বীজ বপনের পরও অন্তত ২০-২৫ দিন কম তাপমাত্রা থাকা প্রয়োজন। বাংলা ধনিয়ার বীজ দু-তিন মাসের বেশি সাধারণ অবস্থায় অঙ্কুরোদ্গম ক্ষমতা থাকে না। এজন্য বীজ সংগ্রহের পর যত শিগগিরই সম্ভব হালকাভাবে ছায়ায় শুকিয়ে বপন করা উচিত। বাংলা ধনিয়ার ছোট বীজ সমানভাবে বোনা বেশ কষ্টকর এবং দক্ষতারও প্রয়োজন। বালির সঙ্গে মিশিয়ে বীজ বোনা ভালো। ১০ সেন্টিমিটার দূরত্বে লাইনে অথবা ছিটিয়ে বীজ বপন করা যায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণভাবে প্রতি হেক্টরে ৪০ কেজি হারে বা প্রতি বর্গমিটারে চার গ্রাম অর্থা প্রতি শতাংশ জমিতে ১৬০  গ্রাম বীজ বপন করে সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া যায়। তবে জিবারেলিক অ্যাসিড৩ (জিএ৩) এক হাজার পিপিএম ও কাইনেটিন (৫০ পিপিএম) হরমোন মিশ্রণে বীজ ১ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে পানি ঝরিয়ে হালকা শুকিয়ে বপন করলে এর অর্ধেক বীজই যথেষ্ট। অঙ্কুরোদ্গম হার দ্বিগুণ হওয়ায় বীজহার অর্ধেকে নেমে আসে। এতে প্রতি হেক্টরে দেড় হাজার টাকার হরমোন প্রয়োজন হলেও বীজের খরচ প্রায় ৫০ হাজার টাকা কমে যায়। আর অল্প বীজে বেশি জমিতে আবাদ করে কৃষক বেশি লাভবান হতে পারেন। ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে বীজ বপনের পর মাটি উপরের স্তরের (০.৫ সেন্টিমিটার গভীরতা পর্যন্ত) সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। লাইনে বপন করলে ১.০-১.৫ সেন্টিমিটার গভীর নালা করে নালাতে লাইনে বীজ ছিটিয়ে দুই পাশের মাটি দিয়ে হালকাভাবে ঢেকে দিতে হবে। ক্ষুদ্রাকৃতির বীজ বলে ও প্রতি শতাংশে ১৬০  গ্রাম অথবা হরমোন মিশ্রণে চুবানো ৮০ গ্রাম বীজ আপাতদৃষ্টিতে অনেক বেশি বলে মনে হয়। কিন্তু এর সব বীজ একসঙ্গে গজায় না। একই দিনে বোনা বীজ গজাতে ১৫ থেকে ৯০ দিন পর্যন্ত সময় নেয়। ফলে একবার বীজ বপন করেও কৃষক অনেকবার (চার-আটবার) ফসল তোলা যায়।

সাধারণত বাংলা ধনিয়ার সম্পূর্ণ গাছটাই তুলে সংগ্রহ করা হয়। ১৫-২৫ সেন্টিমিটারের মতো পাতাসহ লম্বা গাছগুলো তুলে নেয়া হয়। মরা বা পুরনো পাতা অপসারণ করে পানিতে ধুয়ে এক কেজি বা  আধা কেজির আঁটি বেঁধে বাজারজাত করা হয়। এভাবে বড় চারাগুলো তুলে নেয়ার পর ইউরিয়া সার প্রয়োগ ও আগাছা বাছাই করার পর বাকি গাছগুলো বড় হতে থাকে এবং ১৫-২০ দিনের মধ্য পুনরায় আহরণযোগ্য হয়। এভাবে চার-আটবারে প্রতি হেক্টর জমি থেকে মোট ৩০-৫০ টন (প্রতি শতাংশে ১২০-২০০ কেজি) পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। বেশি উপাদন খরচ (২-২.৫ লাখ টাকা/হেক্টর) সত্ত্বেও বাংলা ধনিয়ার ক্রমবর্ধমান চাহিদা, উচ্চ বাজারমূল্য ও একক পরিমাণ জমিতে অধিক মোট আয় (প্রতি হেক্টরে ১৫-২০ লাখ টাকা) ফসলটিকে পার্বত্যাঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলে দিয়েছে। বাংলা ধনিয়া চাষ করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানিরও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে নিউইয়র্ক, টরন্টো, মধ্যপ্রাচ্য, স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বাঙালি হোটেলগুলোতে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

 

লেখক: অতিরিক্ত পরিচালক (হর্টিকালচার উইং), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন