‘মনোবল শক্ত রেখে কাজটি করার চেষ্টা করেছি’

কনক চাঁপা চাকমা, দেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী। রঙ-তুলি ব্যবহার করে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর জীবনধারাকে ক্যানভাসে তুলে ধরে দেশ-বিদেশে খ্যাতি-সম্মাননা অর্জন করেছেন। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর পর বড় পরিসরে তার আঁকা ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনী চলছে রাজধানীর গুলশানের এজ গ্যালারিতে। প্রদর্শনীর শিরোনামদি ট্রাভেলারস সং। ৯ নভেম্বর শুরু হওয়া একক এ প্রদর্শনী চলবে আগামী শনিবার পর্যন্ত। গতকাল টকিজের মুখোমুখি হয়ে কনক চাঁপা চাকমা জানালেন এ প্রদর্শনীর আদ্যোপান্ত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রুবেল পারভেজ


দীর্ঘ বিরতির পর ফিরে এলেন নিজের আঁকা ছবির প্রদর্শনী নিয়ে। শুরুতেই প্রদর্শনীটি সম্পর্কে আপনার কাছে জানতে চাই।

হ্যাঁ, প্রায় পাঁচ বছর পর একক প্রদর্শনী করছি। আমার জীবনসঙ্গী (নির্মাতা খালিদ মাহমুদ মিঠু) মারা গেছে আজ প্রায় চার বছর হতে চলল। ও চলে যাওয়ার পর এই প্রথম একক প্রদর্শনী করছি। বলা যেতে পারে, ওর চলে যাওয়ার পর এটি একটি গ্র্যান্ড শো। কারণ প্রদর্শনীটির পেছনে আমাকে টানা তিন বছরের প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। 

এতটা সময় নিলেন কেন?

একটি গ্র্যান্ড শো করব বলেই এতটা সময় নিয়েছি। গ্র্যান্ড শো এক বছরেও করা যায়। কিন্তু আমি মনে করি এ সময়টা পর্যাপ্ত নয়। একটু চিন্তাভাবনা করে, বিষয় নির্ধারণ করে সবকিছু গুছিয়ে উঠে তার পরই এগোনো ভালো। তাছাড়া আমি তো মাঠপর্যায়ে কাজ করি। আমি চাকমা বলে আমার জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ধারণা আছে। কিন্তু অন্য আদিবাসীদের সম্পর্কে আমার ততটা ধারণা নেই। এমনিতে বাইরে থেকে কিছুটা জানি, দেখি ও বুঝি। কিন্তু তা দিয়ে তাদের জীবনবোধ সম্পর্কে তো স্পষ্টভাবে জানা সম্ভব নয়। এটা জানতে হলে কাছে গিয়ে দেখতে হয়। সে চেষ্টাই করেছি। এবার সাঁওতাল, গারো, মারমাসহ মোট ছয়টি জনগোষ্ঠীর কাজ করেছি। চেষ্টা করেছি প্রতিটি জায়গায় গিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলে, ওদের নিজস্ব জীবনবোধটাকে বুঝে কাজ করতে। এজন্য এতটা সময় লেগেছে।

এতগুলো নৃগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাদের কোন কোন বিষয়কে তুলে আনার দিকে লক্ষ রেখেছিলেন শুরু থেকে?

এ প্রদর্শনীর বিশেষত্ব হচ্ছে, যে ছয়টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে এক করে কাজটি করা, তাতে তাদের প্রত্যেকের সংস্কৃতি, তাদের প্রতিদিনকার জীবনযাপন ও ঐতিহ্যকে নির্দিষ্টভাবে তুলে এনেছি। এখানে প্রদর্শিত ৭০টি চিত্রকর্মে আমি খুব ভালোভাবে তাদের জীবন-সংস্কৃতির ধারা তুলে আনতে পেরেছি বলে মনে হয়। যে কারণে এবারের কাজটি করে আমি সন্তুষ্ট।

মূলধারার সঙ্গে তাদের বিচ্ছিন্নতা ও সংকট বিদ্যমান। কাজটি করতে গিয়ে এসব বিষয়ের প্রতিফলন তাদের জীবনযাপনে কতটা প্রত্যক্ষ করেছেন?

দুঃখজনক হলেও সত্য, মূলধারার সঙ্গে আদিবাসীদের একটি সংঘাত লেগে আছে। এটা অনেক আগে থেকে। রাজনৈতিকভাবে যদি এ সংঘাত নিরসন করা না যায়, তাহলে হয়তো কখনো এর সমাধান করা যাবে না। আমি আপনি এর সমাধান করতে পারব না। শিল্পী হিসেবে আমি চেষ্টা করি আমার পেইন্টিংয়ের মধ্য দিয়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা সবকিছুকে ফুটিয়ে তুলতে এবং তা মানুষকে জানাতে। আমি আমার শিল্পকর্ম দিয়ে সবাইকে বোঝাতে পারি, দেখুন, আদিবাসীদের জীবন হুমকির মুখে। কারণ তারা মূলধারার সঙ্গে টিকতে পারছে না। তাদের যে অধিকার পাওয়ার কথা, তারা তা পাচ্ছে না। নিজেদের জায়গা থেকে সরতে সরতে তারা অনেক গহিনে চলে যাচ্ছে। এ সংঘাত কারো কাম্য নয়। আমার এ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে যদি তাদের কথা বলতে পারি, তাদের বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে মনে করব, একটুখানি হলেও আমি সার্থক।

মূলধারাকে খুশি রাখার একটা প্রয়াস দেখা যায় এখনকার অনেক শিল্পকর্মে। এর বাইরে আরো অনেক অজানা গল্প রয়েছেএ সত্য তুলে আনার চেষ্টা আপনি করেছেন কিনা এসব চিত্রকর্মে?

অবশ্যই চেষ্টা করেছি। দেশ-বিদেশের অনেকেই এ প্রদর্শনী দেখতে আসছেন। তারা দেখছেন আমাদের দেশে এতগুলো জীবনধারার অস্তিত্ব আছে, এত বিচিত্র গল্প আছে। যা হোক, পেইন্টিং কিন্তু পোস্টার নয় যে হত্যা, লুণ্ঠনের মতো বিষয় সরাসরি তুলে ধরব। ফাইন আর্টসের মাধ্যমে আমি আমার নীরব প্রতিবাদটুকু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। দর্শক ছবি, রঙের ব্যবহার দেখলে বুঝতে পারবে কোথাও কোথাও বেদনা লুকিয়ে আছে। মোটকথা, নন্দনতাত্ত্বিকভাবে আমি আমার ভাবনাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।


শুরু থেকেই নৃগোষ্ঠীর জীবনধারাকে তুলে ধরছেন আপনার শিল্পচর্চায়। এতদিনের জার্নিতে কোন কোন পরিবর্তন দেখলেন? আপনার কোনো মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন এসেছে কিনা?

পরিবর্তন তো আসেই। শিল্প কখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। পেইন্টিংয়ের ক্ষেত্রে যেমন ভিজুয়ালি পরিবর্তন এসেছে, মনস্তাত্ত্বিকভাবেও পরিবর্তন এসেছে আমার। আমি ১০-২০ বছর আগে যে বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করেছি, তাতে পরিবর্তন এসেছে। বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে আগে রিয়েলিস্টিকভাবে তুলে ধরতাম। এবার আমি বিষয়গুলোকে সরলীকরণ করেছি। ফিগার থাকবে কিন্তু ফিগারে ডিটেইল থাকবে না। কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছি সবকিছু নির্দিষ্ট করে পরিপূর্ণভাবে। এবার অ্যাবস্ট্রাকশনেরও সমন্বয় করেছি। এমনকি প্রথার বাইরে গিয়ে ভিন্ন কিছু রঙের ব্যবহার করেছি। সব মিলিয়ে নিরীক্ষাধর্মী কাজ বলা চলে এগুলো। আমার তো মনে হয় এটা সময়ের বিশাল একটা পরিবর্তন। আসল কথা, আমি নিজে কখনোই একঘেয়েমি পছন্দ করি না।

আপনার জীবনসঙ্গী প্রয়াত খালিদ মাহমুদ মিঠু। তিনি চলে যাওয়ার পর এটিই আপনার একক কোনো প্রদর্শনী। এত বড় কাজটি করতে গিয়ে তার শূন্যতার প্রভাব কেমন পড়েছে শিল্পকর্মে?

জানি না মিঠুর অনুপস্থিতি ঠিক কতটা প্রভাব ফেলেছে আমার কাজে। আমি তো কাজ করতে গিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে তাকে মিস করেছি। কারণ ছবি আঁকার সূত্র ধরেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়, জীবনের পথচলা। এরপর ছবি আঁকার জগৎ থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হইনি। এ প্রদর্শনীর জন্য ছবি আঁকতে গিয়ে অনেক সময় মনে হয়েছে, ওর সঙ্গে শেয়ার করতে পারলে ভালো হতো, ও পরামর্শ দিতে পারত। তার পরও মনোবল শক্ত রেখে কাজটি করার চেষ্টা করেছি। এজন্য করেছি যে ও নেই কিন্তু আমাকে কাজ করতে হবে। ও চাইত আমি সারা জীবন ছবি আঁকি। ছবি আঁকাটাকে আমি ভালোবাসি বলে ও চেয়েছিল যে আমি যেন এই জায়গার অনেক উঁচুতে যেতে পারি। ও যেহেতু মন থেকে চাইত, সেহেতু এ বিষয়টিই আমাকে কাজ করতে সাহস জুগিয়েছে। আমার মনে হয় ও আছে আশপাশে, আমাকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। সব মিলিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে কাজটি করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।

আপনার পরবর্তী পরিকল্পনা কী?

এত বড় একটা সলো এক্সিবিশন করলাম যে এরপর আমি কয়েক বছর আর বড় কোনো সলো এক্সিবিশন করব না। কারণ আমি সবসময় মনে করি, দীর্ঘ প্রস্তুতির পর সলো এক্সিবিশন করলে ভালো হয়। এজন্য কমপক্ষে দুই বছরের বিরতি দিয়ে করতে চাই। এছাড়া একটি নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছি, তা হলো আদিবাসী ছেলেমেয়েদের মধ্যে থেকে প্রায় ৭২ জনের মতো শিল্পীর কাজ নিয়ে রাঙ্গামাটিতে যে আর্ট ক্যাম্পটি হয়েছিল, সেই ছবিগুলো দিয়ে সামনে একটি প্রদর্শনী করব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন