অসহনীয় হয়ে পড়েছে ঢাকার বাতাস

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিক পরিবেশ অধিদপ্তর

ঢাকার বায়ুদূষণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অনেক বিশেষজ্ঞই দাবি করছেন বায়ুর মানের দিক দিয়ে ঢাকা সবচেয়ে পিছিয়ে, এমনকি ভারতের দিল্লির চেয়েও পরিস্থিতি খারাপ। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী জানিয়েছেন, ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। শীত মৌসুমে দূষণ আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইটভাটা, মোটরযানের কালো ধোঁয়া ও যথেচ্ছ নির্মাণকাজকে বায়ুদূষণের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে নাসা চিহ্নিত করেছে দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতি ও শিল্পায়নকে। দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির প্রমাণ দিতে গিয়ে একেবারেই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকা। ভবন ও অবকাঠামো উন্নয়নকাজ উন্মুক্তভাবে করার ফলে শহরের বাতাসে ধুলোবালির পরিমাণ বাড়ছে। ভারতের দিল্লি, মুম্বাই, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, চীনের বেইজিং শহরে বায়ুর মান খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় পৌঁছে গেলে সেসব দেশের সরকার বিশেষ স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা জারি করে। নাগরিকদের বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা পেতে নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। কিন্তু বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ নেই বলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছে, যা কাম্য নয়। একসময় ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের জন্য বেশি দায়ী ছিল যানবাহনের জ্বালানি তেল পোড়া ধোঁয়া। ডিজেলে সালফারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ, টু-স্ট্রোক অটোরিকশা নিষিদ্ধ এবং সিএনজিচালিত বাহন নামানোর সিদ্ধান্তে ঢাকা শহরের বায়ুতে সালফারজনিত দূষণের মাত্রা কমেছে। কিন্তু ইটভাটাজনিত দূষণ বেড়েছে। ২০০২-০৩ সালের দিকে ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটার দায় ছিল কম। এখন ইটভাটার দায় বেশি। শিল্প-কারখানার ধোঁয়া ও নির্মাণকাজের দায়ও রয়েছে। এখন প্রয়োজন পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া।

ঢাকার জনস্বাস্থ্য রীতিমতো হুমকির মুখে, বিপন্নপ্রায়। শ্বাসকষ্ট, সর্দি-হাঁচি-কাশি, হাঁপানি, ফুসফুসের অসুখ-বিসুখ নগরবাসীর প্রায় নিত্যসঙ্গী। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণটিকে অবশ্যই আমলে নিতে হবে সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে। নাসা পর্যবেক্ষণে দেখেছে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নাইট্রোজন ডাই-অক্সাইড নির্গমনকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপান বায়ুদূষণের লাগাম টেনে ধরতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করায় পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশেরও অবশ্য কর্তব্য হবে সেসব দেশের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করে বায়ুদূষণের মাত্রা যথাসম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করা। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, দূষণ নিরোধ দূরে থাক, তা নিয়ন্ত্রণেরও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। শুধু বায়ুদূষণই নয়, ঢাকা এখন সবচেয়ে উত্তপ্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে নগরীতে ফাঁকা জায়গা দিন দিন কমে যাচ্ছে। জায়গার তুলনায় কংক্রিটের বাড়িঘরের ঘনত্ব অনেক বেশি। একের পর এক হাইরাইজ ভবন রোদের উত্তাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর সঙ্গে যানবাহনের মাত্রাতিরিক্ত বিষাক্ত ধোঁয়া, সড়কের ধুলোবালি, শিল্প-কারখানার বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ যুক্ত হয়ে তাপমাত্রা বাড়ছে। একটি নগরীতে বায়ুদূষণ রোধ এবং নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা থাকা দরকার, ঢাকা থেকে তা হারিয়ে গেছে।

বাতাসকে দূষণমুক্ত রেখে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য জরুরি নির্মাণাধীন নতুন ভবন ও রাস্তাঘাটের ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। শিল্প-কলকারখানা শহর থেকে দূরে স্থাপন, কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণসহ শিল্পবর্জ্যের নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত অত্যাবশ্যক। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ যানবাহনে সিসামুক্ত জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করা চাই। ইটের ভাটা স্থাপন এবং ভাটায় চিমনি ব্যবহারের মাধ্যমে কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে যথাযথ নিয়ম মেনে চলার বিধান করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, রাস্তার পাশে উন্মুক্ত ডাস্টবিন স্থাপন বন্ধ করতে হবে। নদীর পাড়ে জাহাজ ভাঙা শিল্প, লঞ্চ, স্টিমার নির্মাণ ও মেরামতকালে পানিতে তৈলাক্ত বর্জ্যের মিশ্রণ প্রতিহত করতে পারলে দূষণ অনেকাংশে হ্রাস পাবে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন সুনিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং বড় বড় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প অর্থাৎ এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে, মেট্রোরেলসহ অন্যান্য প্রকল্পে কার্যকর পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা প্রতিপালন, সঠিক ব্যবস্থাপনা অনুসরণপূর্বক মাটি, বালি ও অন্যান্য সামগ্রী পরিবহন ও সংরক্ষণ, কার্যকর কর্মপরিবেশ রক্ষা, সময়মতো রাস্তাঘাট সংস্কার ও মেরামত এবং বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়মিত পানি ছিটানোসহ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। ভারতের চেন্নাই শহরে কেউ পলিথিন ব্যবহার করে না; ঢাকার মানুষ কেন পারবে না? চীনের শহরগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন; বাংলাদেশের শহর কেন পারবে না? আমাদের সামনেই চীনের বেইজিং বায়ুদূষণ কমিয়ে এনেছে কলকারখানা স্থানান্তর ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। অন্যরা পারলে বাংলাদেশও পারবে। তদারকি কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে সাময়িক সমাধান নয়, দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধানে পরিবেশ অধিদপ্তরের উচিত দূষণ কমাতে একটা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সে অনুসারে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও কাজ করা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন