তোমারে সেবিতে...

মাহমুদ রেজা চৌধুরী

যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো বিষয় মন ও হূদয়ে তাড়না দেয়, ততক্ষণ সেই বিষয়ে কথা না বলা একটু কঠিন। সমাজ-সভ্যতায় আজকের মানবিক অধঃপতন দেখে চিত্তে উত্তেজনা, অস্থিরতা, সংশয় ও মনে ক্ষত সৃষ্টি হয়। সমাজ এবং দেশের দুঃসংবাদেও এমনটি হয়। দেশে একদিকে উন্নতি ও প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিক ইতিবাচক মূল্যবোধের দ্রুত অবক্ষয়ের বিচিত্র বাস্তবতা বিবেককে তাড়িয়ে বেড়ায় আর সেটা কালি ও কলমে এসে বন্দি হয়। কাউকে কিছু দিতে চাইলে সেখান থেকে বিনিময় আশা না করার চর্চাটা কঠিন। তবে এই কঠিনের চর্চা সামাজিক বৃহৎ পরিসরে যত বেশি করা সম্ভব বা যাবে, সেটা বড় কল্যাণকে সাহায্য করবে। মানুষ যদি মানুষই না থাকে, তাহলে প্রবৃদ্ধি-উন্নতি কার জন্য, কার স্বার্থে? সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় মানব নির্মিত বা জাগতিক পদ্ধতি যতই ত্রুটিমুক্ত হোক, এর নেতৃত্ব ও পরিচালনার দায়দায়িত্ব মানুষের হাতেই।

মাঝে মাঝে মনে হয়, বিজ্ঞান যে পরিমাণে মানুষের হাতে মানুষ ও মনুষ্যত্বকে হত্যা করার অস্ত্র তুলে দিয়েছে, সেই পরিমাণে হিংসা-বিদ্বেষ বাপ্রতিশোধের বিপরীতে সহনশীলতার সামাজিক ও মানবিক উপযোগিতাকে গুরুত্ব দেয়নি বা দিতে পারেনি।

এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ল।আমাদের বাড়ির পেছনে ছিল ধানক্ষেত। রাতে শেয়ালের ডাক শোনা যায়। পাড়ার কুকুরের সঙ্গে শেয়ালের মাঝে মাঝে লড়াই লাগে। এক-আধটা শেয়াল কখনো কখনো মারা যায়। কিন্তু কোনো কুকুর অন্য কুকুরকে খুন করেছে, এমন চোখে পড়েনি। মানুষ যদি পারস্পরিক হিংসায় কুকুরের স্তরে উন্নীত হতে পারত, তাহলে আমাদের অঞ্চলে শান্তি বৃদ্ধি পেত।’ (প্রবাদ সংগ্রহ, অম্লান দত্ত, পৃষ্ঠা ৫০০, প্রকাশক- আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা ১৯৯৩)

উল্লেখ্য, শ্রী অম্লান দত্তের প্রথম বই ফর ডেমোক্রেসি প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। লেখক একসময় ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। সম্ভবত সেটা ১৯৩৯ (সঠিক সাল মনে নেই), সহপাঠী ছিলেন পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব মরহুম সৈয়দ আলী আহসান।

অম্লান দত্তের নানা লেখায় গণতন্ত্র, মানবতা, মানবচরিত্র এবং সমসাময়িককালের রাষ্ট্র ও সমাজের অনেক দুর্বলতা, সহিংসতা এবং অবিচারের ওঠানামার চিত্রও মেলে। একটা কথা সত্যি যে আমাদের ছোটবেলার অনেক দৃশ্য মনকে যেভাবে গভীরভাবে চঞ্চল রাখত বা করত, এখন সে রকম হয় না। তবু মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি, সমাজে ও রাষ্ট্রে মানুষ হিসেবে কতটা মানুষের পর্যায়ে আমরা আছি। এখন আমাদের চালচলন, আচার-ব্যবহারের কৃষ্টিতে যেভাবে বেঁচে আছি, সেটা কতটা মনুষ্যত্বকে উঁচু করে ধরে রাখতে পারছে? ব্যতিক্রম তো থাকবেই এবং আছেও। ব্যতিক্রম আছে বলেই সভ্যতা টিকে আছে। ব্যতিক্রম তাই ভাবায় না, ভাবায় সচরাচর আমরা যা করি, যেভাবে চলি। রাস্তায় একটা মানুষকে বিপদে পড়লে কতজন এগিয়ে যাই সাহায্য করতে! যদি যাইও সেই বিপদগ্রস্ত মানুষের সামনে, উৎসাহটা থাকে শুধু দেখার জন্য ভিড় করা! লক্ষ করেছি কোথাও আগুন লাগলে কেউ কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছবি বাসেলফি তুলতে! তখন সেখানে দমকল বা উদ্ধারকারী দলের পৌঁছাতে বিলম্ব ও কষ্ট হয়। ফলে ত্বরিত সমাধানে এবং এর অব্যবস্থাপনায় মৃত ও আহতের সংখ্যাই বাড়ে।

মানুষের বৃহত্তম নৈতিক বিধানে একটা নিম্ন মাত্রা আছেযেখানে কোনো বিষয়েনা শব্দটা প্রকাশ বেশি হয় বা অগ্রাধিকার পায়। আর যেটাকে বলি ঊর্ধ্বমান, যাকে হাঁ বা হ্যাঁ বলে অন্যের পক্ষে যেটা ভালো হয়, এটা সাম্প্রতিককালে কমে যাচ্ছে এবং এর চর্চাটাও কমছে বই বাড়ছে না।

অধিকাংশ সময়ই নেতিবাচকের পেছনেই আমরা বেশি ছুটি। গুণীজনরাই বলেন, মানুষই সেই জীব, যে হিংসা পুষে রাখে, আর অতীতের হিংসা নিয়ে অন্ধের মতো ভবিষ্যেক বিপন্ন করে। অনেক রাজনীতিক এবং এর পরিচালনার নেতৃত্বে এ প্রবণতা লক্ষণীয়। তবে এটা সত্য কথা, পৃথিবীতে একটা আদর্শ বা আর্দশিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে এ রকম ধারণার যুক্তিটাও দুর্বল। একটা সমস্যা, আমরা যে যা প্রাণ দিয়ে চাই, সেটাই অবশ্যম্ভাবী ভাবতে বেশি ভালোবাসি। ভুলে যাই কাল ও কালাতীতের পারস্পরিক আকর্ষণেই আদর্শের সৃষ্টি। তাই আদর্শ বদলায় কাল ও যুগের পরিক্রমায়। পঞ্চাশের দশকে সমাজ ও রাষ্ট্রে যে বা যা আদর্শ ছিল, ষাটের দশকে এসে সেটার পরিবর্তন হয়েছে। সেই পরিবর্তনটা একবিংশ শতাব্দীতে আরেক রূপে রূপান্তরিত। মানুষের স্বার্থচিন্তাও বদলে যাচ্ছে, সঙ্গে তার আদর্শও।

এখনকার সমাজে ন্যায়-নৈতিকতা, বিচার-শাস্তি, দেশপ্রেম, প্রতিশোধ, যুদ্ধ বা শান্তিসবকিছুর নতুন নতুন বোধ এবং সংজ্ঞাও বদলে যাচ্ছে রাতে-দিনে, যা দ্রুতই বলা যায়।

কিছুদিন আগে শুনেছি, কাউকে কোনো কাজেঘুষ দিলে সেটাকে ঘুষ বলা যাবে না। সেটা হলো কাজকে ত্বরান্বিত করার জন্য কিছুটাসম্মান বাপুরস্কার’! এখন শুনছি ঘুষ যিনি দেন এবং নেবেন, উভয়ই দোষী এবং এটা রোধ করতে হবে। কেবল এটাই নয়। এখন স্বাধীনতা, মুক্তি, শোষণ, স্বৈরাচার, গুপ্তহত্যা, বিচারভুক্ত বা বিচারবহির্ভূত হত্যাসবকিছুর ব্যাখ্যাও রাতে-দিনে বদলে যায় এবং যাচ্ছে দেশ ও দেশান্তরে।

কখনো কখনো কথায় কথায় কেউ রাষ্ট্রদ্রোহী হন, কারো বা এই দ্রোহ নানা কার্যকরণ দ্বারা সুরক্ষিত। ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে বৃহত্তর রাষ্ট্রে এ রকম প্রবণতা সমাজের সুকল্যাণের পথে অন্তরায়। হিংসার বা হিংসাত্মক বিপ্লবের দহনে সমাজের বাইরে যে অংশটার শেষ বা ইতি হয়, তাতে কিন্তু অসাম্যের বা অবিচারের গভীরের কারণের অবসান বা নির্মূল হয় না।

বিজ্ঞানের সুবাদে মানুষের জীবনের গড় আয়ু বেড়েছে হয়তো, কিন্তু মনে সুখ কতটা বেড়েছে। বিজ্ঞান ছাড়া আমাদের চলবে না, তবে অন্যায় আশা এবং এর ব্যবহারও বড় বিপদের কারণ সৃষ্টি করে। এই সবকিছু আমাদের বাহ্যিক উন্নতির স্থিতিশীলতা এবং এর ফলাফল সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর সঙ্গে সম্পর্কিত এবং যুক্ত।

সমাজের বর্তমান মানবিক অবক্ষয়ের কৃষ্টিকে রোধ না করতে পারলে বা এর উত্তরণ ঘটাতে না পারলে, সামনে বিপদ বাড়বে। উন্নতি, ভোগবিলাস এবং যেকোনো প্রবৃদ্ধিও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। আমাদের চলমান কাল ও সভ্যতা এক চ্যালেঞ্জ ও সংকটের ভেতর দিয়েই এগোচ্ছে।

সুনামির মতো গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের মানবিক আচরণ, সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে। প্রতিদিনের খবরের কাগজগুলোর দিকে চোখ ফেললেই নানা রকমের চারিত্রিক এবং আচার-আচরণের অমানবিক চিত্রগুলো চোখ পড়ে। বহুক্ষেত্রেই এখন স্বাভাবিক মৃত্যুটাও অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে ধাপে ধাপে।

আমাদের মনে শৃঙ্খলার একটা আসন থাকা চাই। এই শৃঙ্খলিত আসন মানে মনের পায়ে শেকল পরা নয়। এই শৃঙ্খলা বাইরের সঙ্গে ভেতরের যোগ ঘটানোর একটা অভ্যাসের চর্চাকে বোঝায়। এ অভ্যাসটা হচ্ছে ইতিবাচক মূল্যবোধের অনুশীলনের পথে বিরতিহীনভাবে পা পা করে চলা এবং অগ্রসর হওয়া। নিজেকে বুঝতে অন্যকেও বোঝার মানসিকতা রচনা করা। অন্য মত, অন্য মানুষ, অন্য ধর্ম এসব বোঝার পরিবর্তে এখন আমাদের চরিত্রে এক রকম রাজতান্ত্রিক মনোভাব একাই শ্রেষ্ঠ। এই মনস্তত্ত্বের প্রভাব বেড়েই চলছে। এতে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে শুভ যোগ এবং এর সমন্বয় ঘটছে না। আপাতত উত্তরণের পথে রাষ্ট্র ও সমাজের অধিপতিদের এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকার এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের এ ব্যাপারে বিভিন্ন দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার পরিসর কিন্তু ব্যাপক। আমাদের মন ও মননকে সেবিতে আমিত্বের অহংকার এবং এর অন্ধকারে সবই যেন কালো মেঘে ঢেকে না যায়। সমাজে বস্তুগত চাহিদার লাগামহীন দৌড় প্রতিযোগিতায় আমরা যেন শেষ না হই। আমরা রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের অবকাঠামোর অসম বিন্যাসে হারিয়ে ফেলছি এক মানুষ অন্য এক মানুষকে বোঝার অবস্থানের গুরুত্বকে। সবাই একা একা ভালো বা উন্নতি করতে গিয়ে অন্য মানুষের সেবার মনটা হারিয়ে গেছে গহিনে। কবি কাজী নজরুলের সেই কবিতাটা তখন মনে পড়ে।

যেই দধীচির হাড় দিয়ে ওই বাষ্প শকট চলে

বাবু সাব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।

বন্ধু তোমার বুকভরা লোভ দুচোখে স্বার্থ ঢুলী

নতুবা দেখিতে তোমারে সেবিতে

দেবতা হয়েছে কুলি।

সমাজের সাধারণ মানুষ যাদের শ্রম, ত্যাগ, সহনশীলতা উৎপাদন ও বিনির্মাণের কারণে সমাজের উন্নতি রক্ষিত হচ্ছে, তারাই দেবতাতুল্য আমাদের কাছে। কোনো স্বার্থে ও ভোগের কারণে তাদের যেন কুলি না মনে করি কেউ।

 

মাহমুদ রেজা চৌধুরী: রাজনীতি বিশ্লেষক

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন