পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি

৬৫ বছরে মাত্র পাঁচটি!

মেহেদী হাসান রাহাত

 দীর্ঘমেয়াদে কোনো কোম্পানির পারফরম্যান্স যত ভালো হয়, শেয়ারহোল্ডাররা রিটার্নও তত বেশি পান। রিটার্ন বেশি হলে বিনিয়োগকারীদের কাছে সে কোম্পানির শেয়ারের চাহিদা বাড়ে। এভাবে বেড়ে যায় ওই কোম্পানির ভ্যালুয়েশন। সাধারণত ১ বিলিয়ন ডলার কিংবা তার বেশি ভ্যালুয়েশনের কোম্পানিকে আর্থিক বিশ্লেষকরা বড় ও ভালো কোম্পানির স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের বয়স ৬৫ বছর হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচটি কোম্পানি বিলিয়ন ডলারের স্বীকৃতি পেয়েছে। যদিও বাংলাদেশের সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশ ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামে বিলিয়ন ডলারের কোম্পানির সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। আর প্রতিবেশী ভারতে এ সংখ্যা দুই শতাধিক।

দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত যে পাঁচ কোম্পানির বাজার মূলধন বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে তার প্রথমেই আছে টেলিকম খাতের বহুজাতিক কোম্পানি গ্রামীণফোন। বিলিয়ন ডলার বাজার মূলধনের কোম্পানির তালিকায় এর পরেই আছে বহুজাতিক ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি (বিএটিবিসি) লিমিটেড। এ তালিকায় তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে আছে যথাক্রমে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ইউপিজিডিসিএল) ও রেনাটা লিমিটেড। এই পাঁচ কোম্পানির মোট বাজার মূলধন ১ লাখ ৪ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা, যা ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের ২৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গতকাল ডিএসইর মোট বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর অ্যাকাউন্টিং ফর ক্যাপিটাল মার্কেট ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের স্টক এক্সচেঞ্জের পথচলা দীর্ঘদিনের হলেও এখানে করপোরেট ডেভেলপমেন্ট হয়নি। আমাদের উদ্যোক্তাদের মধ্যে করপোরেট কালচার কম। তাদের বেশির ভাগই স্বল্পমেয়াদের কথা চিন্তা করেন। ফলে সেভাবে আমাদের এখানে বড় কোম্পানি গড়ে ওঠেনি। ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি উদ্ভাবন ও সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলে একসময় আমাদের দেশেও বিলিয়ন ডলারের কোম্পানির সংখ্যা আরো বাড়বে।

গতকালের মুদ্রাবাজার অনুসারে, ১ বিলিয়ন ডলারের মূল্যমান ছিল বাংলাদেশী মুদ্রায় ৮ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। বিলিয়ন ডলারের কোম্পানির তালিকায় সবার উপরে থাকা গ্রামীণফোনের বাজার মূলধনের পরিমাণ ৪৪ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি।

বাজার মূলধনে গ্রামীণফোনের পরেই রয়েছে আরেক বহুজাতিক কোম্পানি বিএটিবিসি। ১৯৭৭ সালে তালিকাভুক্ত তামাক খাতের এ কোম্পানির বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৫০৮ কোটি টাকায়।

বিএটিবিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) প্রেসিডেন্ট শেহজাদ মুনিম বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ বড় কোম্পানিই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়। তালিকাভুক্ত হওয়ার যে সুবিধা সেটিও খুব বেশি নেই। তার ওপর অনেকেই গভর্ন্যান্সের আওতায় আসতে চান না। আমাদের পুঁজিবাজারের আকারও খুব বেশি বড় নয়। এসব কারণেই আমাদের এখানে বিলিয়ন ডলারের কোম্পানির সংখ্যা কম বলে আমি মনে করি।


দেশের ওষুধ খাতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানির বাজার মূলধন ১৭ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। এই পরিমাণ বাজার মূলধন নিয়ে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস রয়েছে বিলিয়ন ডলার বাজার মূলধনের কোম্পানির তালিকায় তৃতীয় স্থানে।

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের নির্বাহী পরিচালক (হিসাব ও অর্থ) কবির রেজা বণিক বার্তাকে বলেনআমাদের বাজার মূলধন কম হওয়ার কারণে বিলিয়ন ডলার কোম্পানির সংখ্যা বেশি নয়। তাছাড়া অনেক বড় কোম্পানি স্বেচ্ছায় পুঁজিবাজারে আসছে না। এটিও একটি কারণ। আমাদের এখানে পুঁজিবাজারের তুলনায় ব্যাংকঋণকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এটিও পুঁজিবাজার বিকশিত না হওয়ার অন্যতম কারণ।

২০১৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানি ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ইউপিজিডিসিএল) বিলিয়ন ডলারের কোম্পানির তালিকায় চতুর্থ স্থানে থাকা ইউপিজিডিসিএলের বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা।

বিলিয়ন ডলার বাজার মূলধনের পাঁচ কোম্পানির মধ্যে সবার শেষে আছে ওষুধ খাতের আরেক কোম্পানি রেনাটা লিমিটেড। ১৯৭৯ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকায়।

যদিও বাংলাদেশের চেয়ে কম জিডিপি নিয়েও ভিয়েতনামে বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি রয়েছে ৩০টির বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ তথ্যানুসারে, ভিয়েতনামের নমিনাল জিডিপি ২৬১ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের নমিনাল জিডিপির আকার যেখানে ৩১৭ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার।

মালয়েশিয়ার নমিনাল জিডিপি বর্তমানে ৩৬৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। দেশটিতে বর্তমানে সাতটি কোম্পানি রয়েছে, যাদের বাজার মূলধন বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। মালয়েশিয়ার বাজার মূলধনের শীর্ষ কোম্পানি মালায়ান ব্যাংকিং বারহাদের বাজার মূলধন ২৪ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার।

থাইল্যান্ডের জিডিপির আকার ৫২৯ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। দেশটির ১৫টি কোম্পানি রয়েছে, যাদের বাজার মূলধন বিলিয়ন ডলার কিংবা তার বেশি। থাইল্যান্ডের শীর্ষ কোম্পানি পিটিটি পাবলিক কোম্পানি লিমিটেডের বাজার মূলধন ৪২ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার।

জিডিপির আকারের দিক দিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। বর্তমানে দেশটির নমিনাল জিডিপির পরিমাণ ২৮৪ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। বাজার মূলধনে পাকিস্তানের শীর্ষ ৪০টি কোম্পানির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এর মধ্যে নয়টি কোম্পানির বাজার মূলধন বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

এছাড়া ইন্দোনেশিয়ায় বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি রয়েছে ছয়টি। ১ হাজার ১১১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার জিডিপির দেশটিতে শীর্ষ কোম্পানি পিটি ব্যাংক সেন্ট্রাল এশিয়া টিবিকের বাজার মূলধন ৫৪ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের জিডিপি বর্তমানে ২ হাজার ৯৩৫ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। দেশটিতে বিলিয়ন ডলার কোম্পানির সংখ্যা দুইশর বেশি। ভারতে বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবার উপরে রয়েছে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, যার বাজার মূলধন ১২৯ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার।

জিডিপির আকারে বাংলাদেশের চেয়ে কিছুটা বড় ফিলিপাইন। ৩৫৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার জিডিপির দেশটিতে বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি রয়েছে পাঁচটি। ফিলিপাইনের শীর্ষ কোম্পানি এসএম ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশনের বাজার মূলধন ২৫ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ভিয়েতনামের জিডিপি আমাদের চেয়ে কম হলেও তাদের জনসংখ্যা কম, ফলে মাথাপিছু জিডিপি আমাদের চেয়ে বেশি। তাছাড়া ভিয়েতনামের রফতানি প্রবৃদ্ধিও আমাদের চেয়ে ভালো। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি বেশি। তাছাড়া পাকিস্তান আমাদের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও উত্তরাধিকারসূত্রে তাদের বেশকিছু বড় কোম্পানি ছিল। আমাদের অর্থনীতি যখন আরো বড় হবে তখন আমাদের এখানেও বিলিয়ন ডলারের কোম্পানির সংখ্যা বাড়বে। তবে আমাদের দারিদ্র্যের হার কমার গতি কমে গেছে। সেদিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে হবে। ব্যাংকঋণ ঢাকা ও চট্টগ্রামে কেন্দ্রীভূত, সেটিকে সারা দেশে বিস্তৃত করতে হবে। আঞ্চলিক দারিদ্র্য নিরসন করতে হবে। সর্বোপরি কর্মসংস্থান বাড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন