দুর্বল যোগাযোগ অবকাঠামো

সড়ক আইন বাস্তবায়নের উপযুক্ত নয় ঢাকা

শামীম রাহমান

প্রত্যেক মোটরযানচালক সিগন্যাল বাতি মেনে চলবেন। একইভাবে ট্রাফিক সাইন, সংকেতের মতো বিষয়গুলোও মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে নতুন সড়ক পরিবহন আইনে। কোনো চালক এসব না মানলে সেটি আইনের ৪২ নম্বর ধারায় অপরাধ বলে গণ্য হবে, যার শাস্তি এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ড এবং চালকের ১ পয়েন্ট কর্তন। কিন্তু ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যাল বাতিগুলো বর্তমানে যে পদ্ধতিতে ব্যবহার হচ্ছে, তাতে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর ৪২ নম্বর ধারা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভজকট অবস্থা তৈরি হবে বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।

সড়ক পরিবহন আইনের ৪৭ ধারায় বলা আছে, নির্ধারিত এলাকা ব্যতীত মোটরযান পার্কিং করা যাবে না। একইভাবে যাত্রী বা পণ্য ওঠা-নামার নির্ধারিত স্থান ও সময় ছাড়া মোটরযান থামানো যাবে না। আইনের এ বিধান লঙ্ঘন করলে অভিযুক্ত চালকের অনধিক ৫ হাজার টাকা জরিমানা ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের ১ পয়েন্ট কেটে নেয়া হবে। তবে মোটরযানচালকদের অভিযোগ, ঢাকায় পার্কিং ও যাত্রী বা পণ্য ওঠা-নামার জন্য নির্ধারিত স্থান প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ফলে যাত্রী বা পণ্য তুলতে-নামাতে বাধ্য হয়েই অনির্ধারিত স্থানে গাড়ি থামাতে হয়। তাদের মতে, পার্কিং ও যাত্রী ওঠা-নামার পর্যাপ্ত স্থান না পেলে আইনের এ ধারা মান্য করা সম্ভব হবে না।

পথচারীদের সড়ক পারাপারে জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস (যদি থাকে) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে নতুন আইনে। আইনটির ৪২ নম্বর ধারা অনুযায়ী সড়ক পারাপারে এসব ব্যবহার না করা দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভারব্রিজ, আন্ডারপাসগুলোর মান ও নকশা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে পথচারীরা। পাশাপাশি তাদের অভিযোগ, প্রয়োজনের তুলনায় এসব অবকাঠামোর সংখ্যা অনেক কম। এ কারণে সেগুলো ব্যবহারে পথচারীদের অভ্যস্ততাও কম।

ঢাকায় রাস্তা কম, গাড়ি বেশি। তার চেয়ে বেশি গণপরিবহনের যাত্রী। ফলে গাড়িতে উঠতে গিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় যাত্রীরা। বেশির ভাগ গাড়িচালকের বৈধ লাইসেন্স নেই। ফিটনেস নেই বাস-মিনিবাসের। রাস্তা ভাঙাচোরা। অলি-গলির রাস্তা অপরিকল্পিতভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে মূল রাস্তার সঙ্গে। রাস্তা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে দোকানপাট। সব মিলিয়ে চরম বিশৃঙ্খলায় পূর্ণ ঢাকার পরিবহন খাতটিতে শৃঙ্খলা ফেরাতে সবার আগে অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, পরিবহন পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো অবকাঠামো। কিন্তু আমরা সেদিকে জোর না দিয়ে কঠোর আইন করে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছি। এটা যেমন বাস্তবসম্মত নয়, তেমনি বিজ্ঞানসম্মতও নয়। ঢাকায় এখনো কোনো সিটি বাস টার্মিনাল বানানো হয়নি। পর্যাপ্ত ট্রাক টার্মিনাল নেই। আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালগুলো শহরের ভেতরে। ফুটপাত হাঁটার উপযোগী না। ফিট গাড়ির চেয়ে আনফিট গাড়ির সংখ্যাই বেশি। বাসচালকও অবৈধ, আবার লেগুনা বা রিকশা ও তার চালকও অবৈধ। এগুলো সংস্কার না করে সড়ক আইন কোনোভাবেই প্রয়োগ করা যাবে না।

তিনি আরো বলেন, সিএনজিচালিত অটোরিকশা যখন ঢাকা শহরে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল, তখনই কিন্তু সেটি কোথায় দাঁড়াবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা দরকার ছিল। একই কথা বাসসহ অন্যান্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সড়ক আইনের মতো রাইডশেয়ার নীতিমালাতেও নির্ধারিত স্থান ছাড়া যাত্রী তোলা-নামায় নিষেধাজ্ঞা আছে। ভাড়া নৈরাজ্য, অবৈধ বাহনসহ ঢাকার পরিবহন খাতটির যত অব্যবস্থাপনা, তার জন্য দায়ী প্রাতিষ্ঠানিক গাফিলতি। পরিবহন খাতে ঘাটতি অনেক বেশি। এ কারণে খাতটি নিয়ন্ত্রণ ও সুশৃঙ্খল করতে সরকার কখনই সফল হয়নি। অবকাঠামো উন্নয়ন ও গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন না করলে যত কঠোর আইনই করা হোক না কেন, তার সুফল মিলবে না।

তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. কামরুল আহসান বলছেন, নতুন সড়ক আইনটির প্রয়োগ হচ্ছে ধীরে ধীরে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, এখনই কঠোর শাস্তি বা জরিমানার দিকে আমরা যাচ্ছি না। আইনটি প্রয়োগের জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে জনসচেতনতা তৈরি। মানুষ সচেতন হলে পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা এমনিতেই অনেক কমে যাবে।

ঢাকার যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের এখানে মেট্রোরেল হচ্ছে, বাস র্যাপিড ট্রানজিট হচ্ছে। বাস ব্যবস্থার আধুনিকায়নও হচ্ছে। পাশাপাশি আমরা আজই (গতকাল রোববার) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক করেছি। বৈঠকে ঢাকায় পর্যাপ্ত পার্কিং স্পেসসহ এ সম্পর্কিত অন্যান্য যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমি মনে করি, ঢাকার যোগাযোগ অবকাঠামোয় বর্তমানে যে সমস্যাটি রয়েছে, তা সাময়িক। আর এটার জন্য সড়ক আইন প্রয়োগও বাধাগ্রস্ত হবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন