বগুড়ার তৈরি কৃষি যন্ত্রাংশ উত্তরাঞ্চলের চাহিদা
মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে এখন। মূলধনি যন্ত্র, বাইসাইকেল ও
নির্মাণ উপকরণ তৈরি হচ্ছে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে। খুলনা-বরিশালে তৈরি হয়
কারখানার যন্ত্রাংশ আর চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা শিল্পের উপকরণ। বেসরকারি উদ্যোগে
বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠা এসব হালকা প্রকৌশল শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ
ও পরোক্ষভাবে ৬৬ লাখ মানুষের জীবিকা জড়িয়ে
আছে। যদিও বিশেষ নীতিসুবিধা না থাকায় কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি থেকে পিছিয়ে রয়েছে সব
শিল্পের ‘মা’খ্যাত এ হালকা
প্রকৌশল।
দেশে হালকা প্রকৌশল শিল্প বাজারের আকার ৩১০ কোটি
ডলারের। এ তথ্য উল্লেখ করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) এক প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশ নিয়ে ‘কমপ্রিহেনসিভ
প্রাইভেট সেক্টর অ্যাসেসমেন্ট’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ
থেকে প্রতি বছর ৩৫ কোটি ৬০ লাখ ডলারের
হালকা প্রকৌশল পণ্য রফতানি হয়। বর্তমানে এ
খাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে আট লাখ মানুষের। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের হালকা প্রকৌশলপণ্য
বাজারের আকার হবে ১ হাজার ২০৬ কোটি ডলারের। সরকারের অগ্রাধিকারে থাকলেও ক্ষুদ্র-মাঝারি (এসএমই) শ্রেণীর এ হালকা
প্রকৌশল শিল্পে প্রয়োজনীয় বিশেষ নীতিসুবিধার ঘাটতি রয়েছে।
লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প সমিতির সভাপতি আব্দুর
রাজ্জাক বণিক বার্তাকে বলেন, হালকা প্রকৌশল শিল্পের বড় বাধার মধ্যে প্রথমেই আছে
অর্থায়ন। হালকা প্রকৌশলে অর্থায়ন হয় না, কারণ আমাদের ইকুইটি দেয়ার মতো সক্ষমতা নেই। ইকুইটি
অ্যান্ড অন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ফান্ডে (ইইএফ) অ্যাকসেসও নেই আমাদের। ব্যাংকের ক্যাপিটালও নেই। আবার
বিশেষ কোনো তহবিল গঠন করে আমাদের পৃষ্ঠপোষকতার উদ্যোগও নেই। এ শিল্পে যারা বিনিয়োগ
করবেন, তাদের সুদবিহীন ঋণ
দেয়া হবে এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে। সুদ
যেটা আসবে, প্রণোদনা হিসেবে
সেটা সরকার পরিশোধ করবে। এগুলো যথাযথভাবে বিতরণে সহায়তা করবে আমাদের সংগঠন। খেলাপি
না হওয়ার গ্যারান্টিও আমরা দেব।
হালকা প্রকৌশলপণ্যের জন্য একটি আলাদা শিল্প পার্ক গড়ে
তোলা প্রয়োজন বলেও মনে করেন আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, বিসিকের আওতায় এ
শিল্পের জন্য পৃথক ও একক পার্ক গড়ে তোলা যেতে পারে। একটা প্রকল্প পরিকল্পনা ছিল, যেটা ১২ বছর ধরে
চলছে ২৫ একর জমিতে মুন্সীগঞ্জ জেলায়। সার্বিকভাবে বলতে গেলে এ শিল্পের জন্য
প্রয়োজন পরিকল্পিত নীতিসহায়তা।
উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, কাঁচামাল ও তৈরি পণ্য আমদানির
ক্ষেত্রে অবাস্তব শুল্ক কাঠামো ও অসম ভ্যাট আরোপ করে এ খাতের উন্নয়ন ও বিকাশের
পথকে আরো দুরূহ করে রাখা হয়েছে। যেসব শিল্পের কাঁচামাল দেশে উৎপাদন হয় না, সেসব পণ্যের ওপর
থেকে শুল্ক কর ও মূসক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা বাঞ্ছনীয়। যেমন অ্যালুমিনিয়াম, তামা, পিতল, জিংক, এলয় স্টিল, পিগ আয়রন, স্ক্র্যাপ, হার্ডকোক ইত্যাদি
দেশে তৈরি হয় না, বরং এসব কাঁচামাল
দিয়ে শিল্পে উৎপাদন ও মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে জিডিপিতে অবদান রাখার সুযোগ
সৃষ্টি হয়।
হালকা প্রকৌশল শিল্পের আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কারখানাগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা। ফাউন্ড্রি, কৃষি যন্ত্র, এলপিসি, সিলিন্ডার—এ ধরনের হালকা
প্রকৌশলপণ্য তৈরি হয় বগুড়ায়। পাশাপাশি হালকা প্রকৌশলপণ্যের কেন্দ্রগুলোর মধ্যে আছে
রংপুর, দিনাজপুর ও সিলেট।
এ অঞ্চলে তৈরি হয় অটোমোবাইল, রেলওয়েজ ও কারখানার যন্ত্রাংশ। মূলধনি যন্ত্র, বাইসাইকেল, নির্মাণ উপকরণ
তৈরি হয় ঢাকা, গাজীপুর ও
নারায়ণগঞ্জে। খুলনা-বরিশালে তৈরি হয়
কারখানার যন্ত্রাংশ। আর চট্টগ্রামে তৈরি হয় জাহাজ ভাঙা শিল্পের উপকরণ। এসব শিল্পকে
একটি আলাদা শিল্প পার্কে নিয়ে এলে শিল্পের সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সহজ হবে
বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
এদিকে কাঠামো বিবেচনায় হালকা প্রকৌশলকে ক্ষুদ্র-মাঝারি ও
অনানুষ্ঠানিক শিল্প হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছে ইউএসএআইডি। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা
হয়েছে, এ শিল্পের
কর্মসংস্থানে নিয়োজিতদের বলা হয় প্রকৌশল বা যন্ত্র কারিগর। এদের কোনো আনুষ্ঠানিক
শিক্ষা নেই। হতদরিদ্র এ জনগোষ্ঠী সুবিধাবঞ্চিত আর্থসামাজিক পটভূমি থেকে উঠে এসেছে।
এ কর্মীরাই দেশের উৎপাদন শিল্পের জন্য বড় নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছেন। ফলে দেশেই
তৈরি হচ্ছে স্পেয়ার পার্টস,
কাস্টিং, মোল্ডস-ডাইজ, অয়েল-গ্যাস পাইপলাইন
ফিটিংস ও হালকা যন্ত্র। এছাড়া কিছু শিল্পের জন্য পূর্ণাঙ্গ যন্ত্রও তৈরি হচ্ছে
দেশে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৫০
হাজারেরও বেশি মাইক্রো আর প্রায় ১০ হাজার ছোট ও মাঝারি হালকা প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান
গড়ে উঠেছে। এসএমই ফাউন্ডেশন তাদের এক সমীক্ষায় দেশের ১৮টি জেলায় ৩১টি ক্লাস্টারে ৭
হাজার ৫০০ হালকা প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে। ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি
ছাড়াও দেশে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও হালকা প্রকৌশলপণ্য উৎপাদনে সম্পৃক্ত
রয়েছে। এর মধ্যে আছে ওয়ালটন, আরএফএল, মেঘনা ও এসিআই। বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদিত হালকা
প্রকৌশলপণ্যের মধ্যে আছে নাটস, বোল্টস, মোল্ডস ও বাইসাইকেল। দেশের কৃষি খাতে যন্ত্র তৈরিতে
মেটাল, আলিম ইন্ডাস্ট্রিজ
ও এসিআই মোটর তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প সমিতি সূত্রমতে, স্বাধীনতার পর গত
প্রায় চার দশকে শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা
করে সীমিত সামর্থ্য দিয়ে দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা প্রতি বছর দেশের অর্থনীতিতে
৩০-৩৫ হাজার কোটি টাকার অধিক পণ্য ও সেবার জোগান দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নানা সমস্যা, সংকট ও
প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে এ সম্ভাবনাময় শিল্প জাতীয় অগ্রগতিতে কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখতে
পারছে না। এ সেক্টরকে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় দাঁড় করাতে হলে সরকারি ও বেসরকারি
যৌথ উদ্যোগে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ও
টেকসই কর্মসূচি হাতে নেয়া দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের কৃষি থেকে শুরু করে পোশাক, সিমেন্ট, কাগজ, পাট, বস্ত্র, চিনিসহ অনেক
শিল্পেরই ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বা পশ্চাৎ সংযোগ শিল্প
হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে হালকা প্রকৌশল শিল্প। ক্রমেই অভ্যন্তরীণ চাহিদা
বাড়তে থাকলেও দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে
(জিডিপি) এ শিল্পের অবদান ১ শতাংশের কাছাকাছি। বিশেষ
নীতিসুবিধার ঘাটতির প্রভাবেই কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারছেন না
উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেকানিক্যাল
ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্রোপ্রিয়েট টেকনোলজির (আইএটি) পরিচালক মোহাম্মদ
আরিফ হাসান মামুন বণিক বার্তাকে বলেন, বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে প্রথমেই আছে হালকা প্রকৌশল
পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে আরোপিত উচ্চহারের শুল্ক। উচ্চহারে শুল্ক দিয়ে যে পণ্যটি
তৈরি হচ্ছে, সেই একই পণ্য
আমদানিও হচ্ছে, কিন্তু সেটির
আমদানি শুল্ক কম। এভাবে দেশে তৈরি পণ্য ও আমদানি করা পণ্যটি অসম প্রতিযোগিতায় পড়ে
যাচ্ছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের হালকা প্রকৌশল শিল্পের
৪০ হাজারেরও বেশি কারখানায় সরাসরি ছয় লাখ এবং এ শিল্প পরোক্ষভাবে আরো প্রায় ৬০ লাখ
লোকের জীবিকা নির্বাহ করছে। প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকার
যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং সেবার মাধ্যমে জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে
চলেছে। এ সেক্টরের একজন কারিগর দক্ষতার কারণে বিদেশে গিয়ে একজন অদক্ষ কারিগরের
চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন। কিন্তু তার পরও শিল্পটির পূর্ণ
বিকাশ হচ্ছে সার্বিক নীতি অবকাঠামোর ঘাটতিতে।
বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রের (বিটাকের) পর্যালোচনায় দেখা
যায়, হালকা
প্রকৌশলপণ্যের বৈশ্বিক বাজার ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের। বড় আকারের অভ্যন্তরীণ ও
আন্তর্জাতিক বাজার সত্ত্বেও এ শিল্প পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আছে
পুরনো প্রযুক্তি, দক্ষতার ঘাটতি, অবকাঠামোস্বল্পতা, ক্ষুদ্র আকার, দুর্বল মান, চাহিদার অনিশ্চয়তা, বিপণন ঘাটতি, নীতিসহায়তার অভাব
ও অর্থায়ন ঘাটতি।
দেশে উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য হালকা যন্ত্রপাতি উৎপাদনে প্রণোদনা দেয়া হবে বলে জানিয়ে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল
আহমেদ মজুমদার বলেন, হালকা প্রকৌশল
শিল্প খাতের স্বার্থে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হালকা এ ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এক
জায়গায় স্থানান্তর করা হবে। এতে তাদের বিভিন্ন পরিষেবা প্রদান সহজতর ও দ্রুততর হবে।