বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই শোনা গেল পশুপাখির কিচিরমিচির। ঢুকেই দেখা গেল বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমসংবলিত দেয়ালচিত্র
ঘড়ির কাঁটায় হয়তো তখন ভোর ৫টা। গভীর
নিদ্রায় শায়িত আমি। এদিকে ঘড়ির কর্কশ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়িরইবা কি দোষ! আমিই
তাকে বলেছিলাম সকাল সকাল ডেকে তুলতে। ঘুম থেকে উঠতে মন চাইছিল না। ভাবলাম আরেকটু
ঘুমিয়ে নিই, এরপর উঠে তৈরি হয়ে নেব। নিদ্রাদেবীও তার আবেশ থেকে আমাকে ছাড়লেন না, ফলে
ঘুম ভাঙতে সেই দেরিই হয়ে গেল। কিন্তু সহধর্মিণী সানন্দার ডাকাডাকিতে ঘুম থেকে
উঠতেই হলো। উঠেই তেরি হয়ে নিলাম নতুন গন্তব্যে যাব বলে।
ও বলাই হলো না আজ শ্রীমঙ্গল ভ্রমণের
দ্বিতীয় দিন। আমাদের আজকের গন্তব্য সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা বলে খ্যাত জায়গাটির।
শ্রীমঙ্গলের সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানার কথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। বইয়ে পড়েছি, ভালুক
শিকার করতে গিয়ে কীভাবে সিতেশ বাবু মুখের একাংশ হারিয়েছেন। কীভাবে পশুপাখির
অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে চলেছেন। আগে থেকেই বলা ছিল তিন চাকার বাহনকে, তাই
বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। আমরা চলেছি মহাসড়ক ধরে।
স্নিগ্ধ সকাল, বেশ
ভালোই লাগছিল। দেখতে দেখতে উপস্থিত হলাম বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের সদর দরজায়।
প্রবেশ দ্বারে অনেক মানুষের সমাগম। আমাদের মতো অনেকেই এসেছেন তাদের সন্তানদের
নিয়ে। বেশকিছু সময় লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম। বন্যপ্রাণী সেবা
ফাউন্ডেশনের প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই শুনলাম পশুপাখির কিচিরমিচির। ঢুকেই
দেখা পেলাম বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমসংবলিত দেয়ালচিত্র। ভাবলাম একটু
দেখেই নিই, কিন্তু বাধ সাধলেন সহধর্মিণী। বলল আগে ঘুরে ঘুরে দেখি, পরে
ওগুলো দেখা যাবে। সানন্দার কথামতো সামনে এগিয়ে গেলাম। এবং দেখা পেলাম বিরল
প্রজাতির সোনালি হনুমান। খুব নিরিবিলি বসে আছে দেখে মনে হলো সে সবকিছু পর্যবেক্ষণ
করছে। পাশের খাঁচার বানরকে বেশ উত্তপ্ত দেখলাম, সে খাঁচা ধরে টানাটানি শুরু করছে।
এরপর একে একে দেখতে পেলাম সোনালি হনুমান,
শকুন,
সাদা বক,
বিরল প্রজাতির সোনালি রঙের কচ্ছপ। এ কচ্ছপের
বৈশিষ্ট্য এরা গাছে বাস করে। কখনো পানিতে নামে না, ডাঙায় বিচরণ করতে দেখা যায় কদাচিৎ।
শুকনো খাবার খেতেই পছন্দ করে বেশি। কিছু দূরে দেখা গেল বিষাক্ত শঙ্খিনী সাপ। তার
খাবার দিয়ে রাখা হয়েছে, কিন্তু সে বেশ দূরেই শুয়ে আছে,
মনে হলো খাবার নিয়ে তার ভেতরে কোনো আগ্রহ নেই।
সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম। দেখলাম বন্যপ্রাণীসেবা ফাউন্ডেশনের এক
পরিচর্যাকারী। তার কাছে জানতে চাইলাম সিতেশ রঞ্জন দেবের কি দেখা পাব? উত্তরে
তিনি বললেন সিতেশ বাবু শহরে গেছেন,
তাই তার সঙ্গে আজ দেখা হবে না। শুনে মন খারাপ
হলো বৈকি! বললাম এ প্রতিষ্ঠান শুরুর কথা জানতে চাই।
তিনি বললেন, আমি যতটুকু জানি একসময়কার দুর্দান্ত শিকারি সিতেশ রঞ্জন দেব। ৪৫ বছর আগে পশুপাখির সেবা আশ্রম হিসেবে গোড়াপত্তন করেছিলেন তার বাবা শ্রীশ চন্দ্র দেব। দুরন্ত বালক সিতেশ বাবার নেশা তথা পশুপাখির প্রতি ভালোবাসার অভ্যাস পেয়েছেন। বাবার সঙ্গে থাকতে থাকতে নিজেও যে কখন জীবজন্তুপ্রেমী হয়ে গেছেন, টেরই পাননি। শিকার করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন বহুবার। এর ছাপ আছে তার শরীরে। আছে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার দুঃসাহসিক রোমাঞ্চকর গল্পও। ১৯৯১ সালে কমলগঞ্জের পত্রখোলা চা বাগানে বন্য শূকরের উপদ্রব বেড়ে যায়। চা বাগান কর্তৃপক্ষ সিতেশ বাবুর শরণাপন্ন হন। বাগানে সারা রাত দোনলা বন্দুক দিয়ে শিকার করেন সিতেশ বাবু। শিকার চলাকালে প্রায় আট ফুট লম্বা একটি ভালুকের সামনে পড়েন। ভালুকের থাবায় তার ডান চোখসহ গালের অনেকটা হারিয়ে যায়। টানা দুই মাস চলে চিকিৎসা। সুস্থ হলেও চেহারায় সেই ভয়াল থাবার ছাপ রয়েই যায়।