উচ্চ লজিস্টিকস ব্যয়

ব্যবসা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বড় বাধা

প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকা ও এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্যয়সাশ্রয়ের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছে দেয়া। এটি যেমন স্থানীয় বাজারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারের জন্যও। রফতানি বৃদ্ধির অন্যতম শর্তই হলো স্বল্প ব্যয়ে মানসম্পন্ন পণ্য দ্রুত সরবরাহ করা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বরাবর পিছিয়ে। পণ্য পরিবহন ব্যয় সমপর্যায়ের দেশের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। এর কারণ হিসেবে গবেষণায় অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়, যানজটসহ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার বিষয়টি উঠে এসেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, যানজট পরিস্থিতির উন্নতি হলে লজিস্টিক সেবা ব্যয় অন্তত ৩৫ শতাংশ কমানো সম্ভব। বিলম্বে পণ্য পৌঁছানোর কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যবাহী কনটেইনারকে গড়ে চারদিন অলস পড়ে থাকতে হয়। এ অলস সময় কমানো গেলে পণ্যের দাম বা ব্যবসার খরচ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমানো সম্ভব বলে জানানো হয়েছে। সঙ্গে রফতানি প্রতিযোগিতায়ও উন্নতি ঘটবে। তুলনামূলক কম মজুরি সুবিধার সুবাদে এতদিন রফতানি বাণিজ্যে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছিল। মোট রফতানি পণ্যের ৮৪ শতাংশই তৈরি পোশাকনির্ভর। এ শিল্পে অব্যাহতভাবে বাড়ছে উচ্চ মজুরির চাপ। অন্য শিল্পগুলোয় একই অবস্থা বিরাজমান। স্বাভাবিকভাবে উচ্চ মজুরির কারণে বেড়ে যাবে ব্যবসা তথা পণ্য উৎপাদন ব্যয়। এখন আর কম মজুরি দিয়ে ব্যবসার খরচ বা উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে ব্যবসার খরচ হ্রাস করতে হলে লজিস্টিক ব্যয় কমানোর বিকল্প নেই। বর্তমানে লজিস্টিক সেবায় বাংলাদেশের যে ব্যয় হচ্ছে, তা প্রতিযোগী উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বেশি।

লক্ষণীয়, দেশের পণ্য পরিবহন অতিমাত্রায় সড়কনির্ভর। পণ্য পরিবহনে গতি আনতে গত বছরগুলোয় সরকার সড়ক অবকাঠামোয় বিপুল বিনিয়োগ করেছে এবং জাতীয় মহাসড়কগুলো চার লেনে উন্নীত করার উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের প্রধান করিডোর ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনে উন্নীত হয়ে পূর্ণমাত্রায় সচল রয়েছে। অন্য মহাসড়কগুলোও চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ চলছে। তবে এক্ষেত্রে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার, বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ ব্যয় বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ। দুঃখজনক বিষয় হলো, বিপুল ব্যয়েও সড়ক অবকাঠামো থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না। সড়কগুলো চার লেনে উন্নীতকরণের প্রধান উদ্দেশ্য যানজট কমিয়ে পণ্য পরিবহনে গতি আনা এবং এ-সংক্রান্ত ব্যয় হ্রাস। এক্ষেত্রে উন্নতি সামান্যই। এসব সমস্যার সমাধানে সরকারের যথাযথ বাস্তবায়ন পরিকল্পনা প্রয়োজন। বিমানবন্দরের অবকাঠামো সুবিধা বাড়ানো, পরিচালন দক্ষতার উন্নতি ও পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের নির্বিঘ্ন কার্যক্রমের জন্য আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনার প্রচলন করতে হবে। দক্ষতা আনা ও এয়ারপোর্টের মধ্যে কার্গোর চাপ কমানোর আরেকটি উপায় হলো, এয়ারপোর্টে ডেলিভারি দেয়ার আগে লজিস্টিক সেবা প্রদানকারীদের (ফরওয়ার্ডারস) নিজেদের ওয়্যারহাউজে বন্ডেড কার্গো রাখা ও ব্যবস্থাপনার সুযোগ দেয়া। বর্তমানে কাস্টমস আইনে ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারদের বন্ডেড কার্গো ব্যবস্থাপনার সুযোগ নেই। বিমানবন্দরের কার্গো এলাকায় পণ্য স্ক্যানিং হয় খুব ধীরগতিতে এবং এটা করা হয় গ্যান্ট্রি স্ক্যানার ছাড়া, যা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। আলাদা করে সব বক্স স্ক্যানের পর কনটেইনারে তুলতে হয়। এছাড়া ওজন পরিমাপের জন্য যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বন্ডেড সিএফএস সুবিধা চালু করতে হবে। যার মাধ্যমে এয়ার কার্গো সরাসরি নিরাপত্তা তল্লাশির মাধ্যমে কাস্টমসের নিয়ন্ত্রণে থেকে এয়ারপোর্টে লোডিংয়ের জন্য যেতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার উন্নতি এবং পণ্যের যৌক্তিক দাম নিশ্চিত করতে একটি আধুনিক মাল্টিমোডাল পরিবহন ব্যবস্থা অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া একটি কার্যকর ও টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে লজিস্টিকসের জনবল ও প্রযুক্তির উন্নয়ন দরকার। এজন্য অভিজ্ঞ কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বিশেষত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ব্যবসা বাড়াতে সড়ক ও রেলপথে কর্মরত পণ্য পরিবহন  কোম্পানিগুলো অভ্যন্তরীণ জাহাজ কোম্পানি অথবা লজিস্টিক সরবরাহকারীদের সঙ্গে অংশীদারিত্বে যেতে পারে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে সড়কপথে ট্রাকে করে নেয়ার পরিবর্তে নদীপথে বড় নৌযানে কনটেইনার পরিবহনের মাধ্যমে লজিস্টিকস সেবা উন্নত করা যেতে পারে। আফ্রিকার কয়েকটি দেশ লজিস্টিক ব্যয় কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে। এমনকি পাকিস্তান ও ভারতে লজিস্টিক ব্যয় বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। তারা পণ্য পরিবহনকে আলাদা প্রাধিকার দিয়ে সড়ক নির্মাণ করেছে। পণ্য পরিবহন নির্বিঘ্ন রাখতে ব্যবস্থাপনাগত উন্নতিসহ সময় কমিয়ে এনেছে বলে জানা যাচ্ছে। জ্বালানি ব্যয় কমিয়ে আনতে তারা যানজট এড়িয়ে পণ্য পরিবহনকে গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশে এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার ঘাটতি দৃশ্যমান। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উপায়ে অর্থ আদায়ের প্রক্রিয়াটি নিয়েও ভাবার সময় এসেছে।

কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বন্দর, সড়ক, রেল ও আকাশপথের অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি। সরকারি প্রক্রিয়াগুলো সহজ করাও জরুরি। বাংলাদেশের জন্য বিশেষ করে দরকার কাস্টমস, অবকাঠামো ও লজিস্টিক সেবার উন্নতি। দেশের পরিবহন অবকাঠামোর উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বব্যাপী পণ্য পরিবহনে টেকসই ব্যবস্থা হচ্ছে রেল যোগাযোগ মাধ্যম। দেশের পণ্য পরিবহন একসময় ট্রেননির্ভর ছিল। নানা কারণে এখন সেটি আর নেই। পণ্য পরিবহনের আরেক সহজ মাধ্যম নৌপথ। নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় এটি আমাদের জন্য বাড়তি ভৌগোলিক সুবিধা। নৌ ও রেলপথে পণ্য পরিবহন ব্যয় সড়কপথের তুলনায় এখনো কম। কিন্তু সময় সাশ্রয়ের জন্য ট্রাকে পণ্য পরিবহনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করায় সড়কনির্ভরতা বেড়েছে বটে, তবে যানজট ও অন্য দুর্বলতায় সড়কেও প্রত্যাশিত ফল মিলছে না। বরং এক্ষেত্রে দিন দিন বেড়ে চলেছে পরিবহন ব্যয়। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা টেকসই রেল ও নৌ-যোগাযোগ উন্নয়নের পরামর্শ দিচ্ছেন। এটি আমলে নেয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে দেশের লজিস্টিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নও জরুরি। ডুয়িং বিজনেস সূচকে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা আরো দক্ষ করে তোলার মাধ্যমে যোগাযোগ, ব্যবসার পরিবেশ ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে সরকার জোরালো উদ্যোগ নেবে বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন