বাংলা মানেই সবুজ-শ্যামল গ্রামীণ
প্রকৃতি ও কৃষি-কৃষ্টি বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ দেশ। বাংলা মানেই বট, পাকুড়, ডুমুর, আম, জাম, শিমুল, পলাশ, হিজল, ছাতিম, কদম, শাল, তাল, তেঁতুলসহ
অজস্র দেশী বৃক্ষে আচ্ছাদিত। বাংলা মানেই জুঁই, চামেলি, মালতি, গন্ধরাজ, ভাঁট
ফুলসহ অজস্র লতাগুল্মের বাহার। বাংলার এসব গাছগাছালিকে কেন্দ্র করেই বাস করে বহু
প্রজাতির পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ। মানুষ বেড়েছে ভারসাম্যহীনভাবে। চাহিদা বেড়েছে খাদ্য, বস্ত্র
ও আবাসের। সেই সঙ্গে বেড়েছে ভোগ-বিলাস, বিত্ত-বৈভব, লালসা ও নগদ প্রাপ্তির অসীম চাহিদা। তাই চলছে প্রকৃতি লুণ্ঠনের অজস্র
আয়োজন। কলকারখানার জন্য উন্নয়নের নামে গাছগাছালি সাবাড় করে উজাড় হচ্ছে বন। তা আবার
উদ্ধারের নামে রাষ্ট্রের লাখো কোটি টাকায় শত শত প্রকল্পে চলছে সবুজায়নের এক অদ্ভুত
আয়োজন। রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি সর্বস্তরে চলছে বাংলার বৃক্ষ-প্রকৃতি বিনাশের কাজ।
দ্রুত লাভের জন্য পরিবেশবান্ধব বাংলার
বৃক্ষ বিনাশ করে ইউক্যালিপটাস,
আকাশমণির মতো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিদেশী গাছ
লাগানো হয়েছে এবং হচ্ছে সর্বত্র। হারিয়ে যেতে বসেছে লাখ লাখ বছর ধরে জন্মানো দেশী
বৃক্ষ। ইউক্যালিপটাস বাংলাদেশে ১৯৬০ সালে আনার পর থেকে সরকারি উদ্যোগেও সামাজিক
বনায়নের আওতায় লাগানো হয়েছে সর্বত্র। সারা দেশে রাস্তার পাশে, পুকুরপাড়ে, ক্ষেতের
আইলে এখন চোখে পড়ে এসব পরিবেশ হানিকর গাছ। ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি
গাছ শুধু কাঠের বিবেচনায় রোপণ করা হয়। কিন্তু একটি গাছ মানে তো শুধু কয়েক ঘনফুট
কাঠ নয়। গাছের সঙ্গে প্রধান বিবেচ্য বিষয় বাস্তুতন্ত্র তথা পরিবেশ-প্রকৃতি।
বিবেচনায় নিতে হবে সেসব গাছ বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ। একটি গাছের
সঙ্গে থাকে অনেক প্রজাতির পশু-পাখি, অজস্র অনুজীবের জীবনচক্র ও জীবনপ্রবাহ। মানুষ বুদ্ধি, কৌশল
ও বাহুবলে গাছের সর্বাঙ্গ লুণ্ঠন করছে যেন প্রকৃতিতে একমাত্র মানুষ প্রজাতিই একক
স্বত্বভোগী! কিন্তু প্রকৃতিতে অন্যান্য প্রাণীরও অধিকার রয়েছে। মানুষ এখন ভোগ-বিলাসে ও বিত্ত-বৈভব অর্জনে
আত্মকেন্দ্রিকতায় অন্ধ। এদিকে বিদেশী ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি গাছের গড়ন ও আচরণও অত্যন্ত
আত্মকেন্দ্রিক। এসব গাছ রাত-দিন প্রচুর পানি শোষণ করে। ইউক্যালিপটাস গাছের পানি শোষণসংক্রান্ত
নির্ভরযোগ্য কোনো গবেষণার তথ্য জানা না থাকলেও আমি প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে দেখেছি
যে আমাদের দুটি পাশাপাশি ছোট্ট পুকুরের একটির পাড়ে কিছু ইউক্যালিপটাস গাছের প্রচুর
পানি শোষণ। খরা মৌসুমে এ পুকুরের পানি তলানিতে ঠেকত। অন্য পুকুরপাড়ে সাধারণ দেশী
গাছ ছিল, যার পানি তুলনামূলক অনেক বেশি থাকত। আবার আমাদের একটি জমির যে পাশে
কিছু ইউক্যালিপটাস ছিল, সে পাশের মাটি বর্ষাকালেও দু-চারদিন বৃষ্টি না হলে জল শুকিয়ে ঝরঝরে হতো। আর যে পাশে আম-কদম গাছ ছিল, সে
পাশের মাটি থাকত অনেক আর্দ্র। সেসব ইউক্যালিপটাস গাছ কাটার পর এ সমস্যা আর দেখা
দেয় না। এ রকম তিক্ত অভিজ্ঞতা প্রত্যেক ভুক্তভোগী কৃষকেরই আছে। ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি
গাছের শাখার গড়ন হলো খাড়া ও ছড়ানো। ফলে এসব গাছের ডালে কোনো পশু-পাখিই বাসা
বাঁধতে পারে না। এমনকি বসে বিশ্রামও নিতে পারে না। এদের ফুল-ফল খেতে পারে
না কোনো প্রাণী। পাতা গরু-ছাগলেরও খাবার উপযোগী নয়। এমনকি এদের ওপর কোনো মাইক্রো ফ্লোরা-ফোনা (ক্ষুদ্র
উদ্ভিদ ও প্রাণী) জন্মাতে পারে না। যাকে এককথায় বলা যায় একেবারেই আগ্রাসী আত্মকেন্দ্রিক!
এর সঙ্গে বাংলার পরিবেশবান্ধব বটজাতীয়
বৃক্ষের তুলনা করা যাক। মায়ামাখা ছায়াঘন বটবৃক্ষের শাখার আনুভূমিক গড়ন যেন বাহু
প্রসারিত করে পাখিদের আহ্বান করছে—‘এসো আমার শাখায় বাসা বেঁধে ফল সেবন করো! প্রশস্ত পাতার সুনিবিড় ছায়ায় শান্তির
নীড়ে প্রাণ জুড়াও!’ শুধু পাখি নয়, অজস্র অনুজীব, মৌমাছি, বাদুড়-বানরের নিশ্চিত নিরাপদ আশ্রয়স্থল বট গাছ। আবার বটের নিকট গোত্রীয় ডুমুর
বা খোকসা গাছ পশু-পাখির সারা বছর খাদ্য জোগানদাতা। বনে বাঁদর ও হনুমান অনেকাংশে ডুমুর
ফলের ওপর নির্ভর করে। যজ্ঞ বা জগডুমুর ফল মানুষের অসাধারণ পুষ্টিগুণে ভরপুর
সুস্বাদু উন্নত সবজি। এর ভাজি,
ভর্তা ও ঝোলও রাঁধা হয়। প্রতি ১০০ গ্রাম ডুমুরে
খাদ্যশক্তি ৩৭ কিলোক্যালরি,
১২৬ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন এবং ভিটামিন এ, বি, সি, প্রচুর
আয়রনসহ অন্যান্য উপাদান রয়েছে। ডুমুর খুবই উচ্চমানের ভেষজ গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ।
বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী, গুটিবসন্ত, ডায়াবেটিস, হূদরোগ, কিডনি ও মূত্রসংক্রান্ত সমস্যা,
স্নায়বিক দুর্বলতা, মস্তিষ্কের
শক্তি বৃদ্ধি, সর্দি-কাশি, ফোঁড়া বা গ্রন্থস্ফীতি
(টিউমার)
ও স্ত্রীরোগের চিকিৎসায় জগডুমুর বেশ কার্যকর।
বাংলায় উত্পত্তি বেশির ভাগ বৃক্ষের
ফুল ও ফল সাধারণত সরস ও শোভাপূর্ণ। এসব বৃক্ষ ঘিরে অসংখ্য পশু-পাখির আবাস গড়ে
ওঠে। গাছের গড়নবিশেষে পশু-পাখি তাদের আবাস বা আশ্রয় নির্বাচন করে। হরেক প্রজাতির শালিক, শ্যামা, টিয়া, ঘুঘু, বুলবুলি, বক, বাজপাখি, চিল
বাদুড়সহ অসংখ্য পাখি সাধারণত আম,
জাম,
কাঁঠাল,
বট,
অশ্বত্থ,
খেজুর গাছে বাসা বাঁধে। বাবুই পাখি তাল, নারকেল, খেজুর
গাছের পাতায় অসাধারণ নৈপুণ্যে বাসা বাঁধে,
তা সবারই জানা। বক সাধারণত উচু তেঁতুল গাছে বাসা
বাঁধতে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আমি গ্রামে দেখেছি জঙ্গলের মাঝে বাঁশঝাড় ও
উঁচু তেঁতুল গাছে শত শত বককে বাসা বাঁধতে। আবার কলা-বাদুড়ের আশ্রয়ও উঁচু তেঁতুল গাছ। আমার
দেখা বেশির ভাগ বাদুড়ের বাস তেঁতুল গাছের শক্ত-চিকন ভূমি সমান্তরাল ডালে। তবে তারা
সে গাছকে কেন্দ্র করে আশপাশের অন্যান্য গাছ বা বাঁশঝাড়েও ঝুলে থাকে। আশপাশে বট, পাকুড়, ডুমুর
গাছে এদের আনাগোনা বেশি। টিয়া পাখি নরম কাঠবিশিষ্ট বড় শিমুল গাছের মগডালে গর্ত করে
বাস করে। ছোটবেলায় দেখেছিলাম নদীর ধারে প্রকাণ্ড শিমুল গাছের শীর্ষে শকুনের বাসা।
আজ শিমুল, ছাতিম, তেঁতুল গাছ আর চোখেই পড়ে না। এসব গাছ কেউ আর রোপণ ও পরিচর্যা করে না।
যার দরুন বৃক্ষের বিলুপ্তিতে পাখিদের আবাস আজ চরম সংকটে। ফলে হারিয়ে গেছে অনেক
পাখি প্রজাতি। মানুষ শুধু কয়েক ঘনফুট কাঠের প্রত্যাশায় অন্ধের ন্যায় রোপণ করছে
বিদেশী গাছ। আমাদের ব্যক্তি-সমাজ জীবনের চাহিদা ও চিন্তাধারার বহু পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমান বিত্ত-বৈভবের লোভে
সমাজ-সংস্কৃতির
হয়েছে বিরূপ পরিবর্তন।
আর্দ্র ভূমির সবুজ-শ্যামল আবহমান
বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রকৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। সাধারণত বট বা
অশ্বত্থ বৃক্ষের তলা ছিল মুনি-ঋষির আরাধ্য স্থান। গৌতম বুদ্ধের অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে একযোগে ধ্যানের
কথা শাস্ত্র বা ইতিহাসে রয়েছে। মধ্যযুগে সৃষ্ট বটতলার সাহিত্যের কথা আমরা সবাই
জানি। আধুনিক সাহিত্যে বটবৃক্ষের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে কবিগুরু এক বিশাল ছড়ায় লিখেছেন, ‘লুটিয়ে
পড়ে জটিল জটা, ঘন পাতায় গহন ঘটা,
হেতা-হোতায় রবির ছটা,
পুকুর ধারে বট’। বাংলার স্বরূপ উপস্থাপনে আমাদের
জাতীয় সংগীতে বটবৃক্ষের গুনগান গেয়েছেন,
‘কি শোভা কি ছায়া গো কি স্নেহ কি মায়া গো কি আঁচল
বিছায়েছ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে!’ পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের বিখ্যাত গান কাজল ভ্রমরায় বটবৃক্ষের অনন্য উপমা—‘বটবৃক্ষের
ছায়া যেমন রে, মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে’। এ রকম অসংখ্য কবির অজস্র কবিতায় বটবৃক্ষের উপমা রয়েছে।
বটবৃক্ষ শুধু সাহিত্যে নয়, লোকজ
জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে আছে। রোদ-বৃষ্টি ঝড়-ঝাপটায় আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বট গাছের উপযোগিতা অপরিসীম। হাটবাজার-মেলা তো বটতলা
ছাড়া কল্পনাই করা যেত না। মানুষ তখন কোনো ঠিকানা নিশ্চিত করতে বট গাছকেই ব্যবহার
করত। গ্রীষ্মে প্রখর রৌদ্রে শ্রান্ত শরীরে বিশ্রাম নিতে বটবৃক্ষের তলে বসত মানুষের
মিলনমেলা। বাড়ির পাশে পুকুরপাড়ে বা খেয়াঘাটে বটগাছের নিচে মানুষের জন্য তৈরি করা
হতো বাঁশের মাচা। দুপুর গড়িয়ে চলত গলা ছেড়ে গান, লাগামহীন গল্প। ঝুরিমূলে দোল খাওয়া
নিয়ে শৈশব-কৈশোরে বটবৃক্ষের সঙ্গে সখ্য ছিল না, গ্রাম-বাংলায় বেড়ে ওঠা এমন কাউকে পাওয়া যাবে
না। খেলাধুলা, বেড়ে ওঠা, গড়ে ওঠার বিকাশ কেন্দ্র ছিল সেসব বৃক্ষতলা। বাংলার পথপ্রান্তরের নাম
বটতলা নির্ধারণ করা হয়। বগুড়া,
নওগাঁ ও আমাদের অঞ্চলে একে বটতলী বলে। এ নামকরণে
বাংলার অন্যান্য বৃক্ষেরও প্রভাব দেখা যায়। যেমন পাকুড়তলী, শিমুলতলী, নিমতলী, কদমতলী, তেঁতুলতলী, আমতলী, জামতলী।
সারা দেশে এ রকম রাস্তা-ঘাট ও মাঠের নাম পাওয়া যায়। তবে বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে
সংগতির জন্য বটতলা নামটি বেশির ভাগ স্থানে দেখা যায়।
বট-পাকুড় বৃক্ষের সঙ্গেই শুধু প্রাণীদের
সৌহার্দের সম্পর্ক নয়, অন্যান্য গাছের সঙ্গেও সম্প্রীতির সাক্ষ্য বহন করে। বট অশ্বত্থ বা
পাকুড় গাছের সঙ্গে জড়িয়ে একত্রে বেড়ে উঠতে পারে। তাল, খেজুরসহ
অনেক গাছের সঙ্গে একসঙ্গে বেড়ে উঠতে দেখা যায়। বট-পাকুড় গাছের এ মিলনকে বাংলার মানুষ
দম্পতি বলেও অভিহিত করে। কোনো কোনো বৃক্ষপ্রেমিক আবার বট-পাকুড় পাশাপাশি
রোপণ করে বিয়েও দিতেন একসময়। আমাদের মাঠের মাঝখানে বিশাল একটি বট-পাকুড় গাছ ছিল।
আমরা সেই যুগল বৃক্ষকে বিয়াতলী নামেই ডাকতাম। ২০-২৫ বছর আগে সেটি কাটা হলেও এখনো
সেই মাঠকে বিয়াতলী বলা হয়।
ঐতিহ্যের ধারক ও পরিবেশবান্ধব
বটবৃক্ষ। ৫০ বছরের একটি বটবৃক্ষ মানুষ তথা বাস্তুতন্ত্রে কী উপকারে আসে, তা
প্রকৃতিপুত্র নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা তার একটি হিসাবে দেখিয়েছেন, ২৫
লাখ টাকার অক্সিজেন, মানুষের উপকারী জীবজন্তুর খাবার জোগায় ২০ হাজার টাকার, মাটির
ক্ষয়রোধ ও উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধিতে লাভ হয় ২ লাখ টাকা, বাতাসের
আর্দ্রতা বাড়িয়ে বৃষ্টিপাতে সহায়তায় বাঁচায় ৩ লাখ টাকা এবং বায়ুদূষণ ঠেকানোর জন্য
সাশ্রয় হয় ৫ লাখ টাকা। অথচ আজ মানুষ নগদ প্রাপ্তির জন্য সারা বাংলায় দেশী বৃক্ষ
সাবাড় করে সামাজিক বনায়নের নামে ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি গাছ লাগাচ্ছে।
বহু বছর ধরে বাংলায় জন্মানো বৃক্ষ
অভিযোজনে উপযোগী করেছে নিজস্ব পরিবেশ-প্রকৃতিকে। জনঘন এ দেশে পরিবেশ দূষণ ও প্রকৃতি বিপর্যয় রোধে বাংলার
বৃক্ষগুলোর গুরুত্ব অপরিহার্য। একজন ব্যক্তি জীবদ্দশায় একটি বটবৃক্ষ রোপণ ও
সংরক্ষণ করে কয়েকশ বছর শতকোটি প্রাণীর নিশ্চিত নিরাপদ আবাস ও আহারের ব্যবস্থা করতে
পারবেন। সরকারি বা ব্যক্তি উদ্যোগে বিদেশী গাছ নয়, বরং বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে অধিক
সংগতিপূর্ণ বাংলার এসব বৃক্ষ রোপণ করা এখনই জরুরি।
রতন মণ্ডল: কৃষিবিদ
ও গবেষক