সৌদি আরবের ওয়ারেন বাফেট : প্রিন্স আলওয়ালিদ বিন তালাল

মেহেদী হাসান রাহাত

বিনিয়োগ গুরু ওয়ারেন বাফেটের সঙ্গে মিল থাকায় সৌদি প্রিন্স আলওয়ালিদ বিন তালাল সৌদি আরবের ওয়ারেন বাফেট নামে পরিচিত। বাফেটের মতোই আলওয়ালিদ কৌশলী বিনিয়োগের মাধ্যমে তার ভাগ্য গড়েছেন। রাজপরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বে নিজের একক প্রচেষ্টায় সৌদি আরবের শীর্ষ ধনী হয়েছেন তিনি। ব্লুমবার্গের বিলিয়নেয়ার ইনডেক্স অনুসারে বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের মধ্যে আলওয়ালিদের বর্তমান অবস্থান ৯৩তম। তার সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ৪৫০ কোটি ডলার।

বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের অনেকেই দরিদ্র থেকে ধনী হয়েছেন। কিন্তু প্রিন্স আলওয়ালিদের মাল্টি বিলিয়ন ডলারের সম্পদ অর্জনের গল্পটি অন্য অনেকের মতো নয়। সৌদি আরবের সবচেয়ে ধনী সৌদ রাজপরিবারে ১৯৫৫ সালে তার জন্ম। তিনি সৌদি আরবের প্রথম বাদশা ইবনে সৌদের নাতি এবং বর্তমান বাদশার পূর্বসূরি আব্দুল্লাহ সৌদের ভাতিজা। আলওয়ালিদের পিতা প্রিন্স তালাল সৌদি আরবের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তার মা প্রিন্সেস মোনা আল সোলহ ছিলেন লেবাননের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে। শৈশবেই আলওয়ালিদের মধ্যে ভবিষ্যৎ উদ্যোক্তার গুণাবলি দেখা যায়। রিজ খানের লেখা বইআলওয়ালিদ, বিজনেসম্যান, বিলিয়নেয়ার, প্রিন্স এ আলওয়ালিদের মা তার সম্পর্কে বলেছেন, ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চরিত্র দেখা যায়। একই বইয়ে আলওয়ালিদের  বাল্যবন্ধু রাইদ এল সোলহ বলেন, প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর ১ ঘণ্টা আমি আর আলওয়ালিদ মনোপলি খেলতাম। প্রতিবারই সে আমাকে খেলায় হারিয়ে দিত। আমি মনে করতাম, আমার বুদ্ধির জোরে তাকে হারিয়ে দেব, কিন্তু প্রতিবারই সে আমাকে হারিয়ে দিত। তাই আমি জানতাম সে প্রচুর অর্থ আয় করতে যাচ্ছে।

বয়ঃসন্ধিকালে আলওয়ালিদ অবাধ্য হয়ে উঠতে শুরু করে; এ কারণে তার পিতা-মাতা তাকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনার জন্য সামরিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। ২০ বছর বয়সে আলওয়ালিদ ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে পড়তে যুক্তরাষ্ট্রে যান। ১৯৭৯ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার মেনলো কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। স্নাতক শেষ করেই আলওয়ালিদ তার পিতার কাছ থেকে ৩০ হাজার ডলার ধার নিয়ে ১৯৮০ সালে কিংডম হোল্ডিংস নামে একটি বিনিয়োগ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।  তবে কোম্পানির কার্যক্রম শুরুর ১২ মাসের মাথায় তিনি সব অর্থ হারান। এর ফলে তাকে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হয়। ১৯৮৫ সালে নিউইয়র্কের সারাকজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সামাজিক বিজ্ঞানে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।


যুক্তরাষ্ট্র থেকে পড়াশোনা শেষে আলওয়ালিদ ব্যবসায় ক্যারিয়ার গড়তে সৌদি আরবে ফিরে আসেন। তখন সৌদি আরবের অর্থনীতিতে তেজিভাব চলছিল। সে সময় সৌদি আরবে কার্যক্রম চালাতে আগ্রহী এমন বিদেশী কোম্পানির প্রয়োজন ছিল, যেগুলোয় স্থানীয়রা অংশীদার ও প্রতিনিধি হিসেবে থাকবে। এর ফলে সৌদি আরবের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বিদেশী বিনিয়োগ থেকে প্রচুর মুনাফা করার সুযোগ তৈরি হয়। অন্য আরো অনেক ব্যবসায়ীর মতো আলওয়ালিদ বিদেশী কোম্পানির স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে থাকেন, যারা সৌদি আরবে বিদেশী কোম্পানির করা প্রতিটি চুক্তি থেকে কমিশন হিসেবে মোটা অংকের অর্থ পেতেন। প্রতিটি লেনদেনের বিপরীতে কমিশনের পরিমাণ ছিল সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ।

যদিও সৌদি আরবে বিভিন্ন প্রকল্প চালু করতে আলওয়ালিদ বিদেশী কোম্পানি ও ডেভেলপারসদের সঙ্গে কাজ করতেন, কিন্তু তিনি কমিশন গ্রহণে তেমন ইচ্ছুক ছিলেন না। তার ভাষায়, এটি হচ্ছে দ্রুত টাকা কামানোর পথ এবং তিনি এটিকে ঘৃণা করেন। এর পরিবর্তে আলওয়ালিদ সৌদি আরবে যেসব প্রকল্প চালু করতে সহায়তা করতেন, সেগুলোর মালিকানার অংশ নিতে শুরু করেন। ১৯৮২ সালে দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক একটি কোম্পানির জন্য ক্লাব তৈরির সময় প্রথমবারের মতো তিনি তার এ ধারণার বাস্তবায়ন করেন। তাছাড়া যেসব প্রকল্প থেকে তিনি কমিশনের মাধ্যমে নগদ অর্থ আয় করেছিলেন, সেটি তাকে একটি রিয়েল এস্টেট পোর্টফোলিও তৈরি করতে সহায়তা করে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে আলওয়ালিদ কিংডম হোল্ডিংসের পোর্টফোলিও ডাইভারসিফায়েড করা শুরু করেন। তার একটি উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ হচ্ছে, ইউনাইটেড সোদি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৭ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়া, যেদি সৌদি আরবের একটি তালিকাভুক্ত ব্যাংক ছিল এবং এটি পতনের দ্বারপ্রান্তে ছিল। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অধিগ্রহণের পর আলওয়ালিদ ব্যাংকের অবস্থা পরিবর্তনে অন্যান্য শেয়ারহোল্ডারের সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করেন। এক্ষেত্রে তার কৌশল কাজে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত ব্যাংকটিকে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান সিম্বা ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ কিনে নেয়। ১৯৯০ সালের দিকে আলওয়ালিদের নাম পশ্চিমা বিশ্বের ব্যবসা ও আর্থিক খাতে পরিচিতি পেতে শুরু করে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে সিটিগ্রুপ বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে যায়। ফেডারেল রিজার্ভের মূলধন শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যাংকটির লোন পোর্টফোলিওর অনেক ঋণই অপরিশোধিত থেকে যায়। এর ফলে ব্যাংকটির অনেক শেয়ারহোল্ডারের মধ্যে ধারণা জন্মে, ব্যাংকটির হয়তো পতন হতে যাচ্ছে; এ কারণে এর শেয়ারদরও অনেক কমে যায়। অন্যদিকে আলওয়ালিদ মনে করতেন, সিটিগ্রুপের এ সংকট সাময়িক এবং তিনি শেয়ারদর কম থাকার সুযোগে ব্যাংকটির ৪ দশমিক ৯ শতাংশ শেয়ার ২০ কোটি ৭০ লাখ ডলারে কিনে নেন। এর পর থেকেই সিটিগ্রুপে বিনিয়োগের মূল্য বাড়তে থাকে এবং এখন পর্যন্ত এটি কিংডম হোল্ডিংসের পোর্টফোলিওর অন্যতম অংশ। আলওয়ালিদ বিভিন্ন স্বনামধন্য কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে প্রচুর মুনাফা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে টুইটার, যেটি তালিকাভুক্ত হওয়ার আগেই তিনি এতে বিনিয়োগ করেছিলেন। তাছাড়া ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও হারপার কলিন্স পাবলিশার্সের স্বত্বাধিকারী নিউজ করপোরেশনেও তার বিনিয়োগ রয়েছে। স্ন্যাপচ্যাটে বড় আকারের বিনিয়োগ নিয়ে তার বক্তব্য ছিল, নতুন প্রযুক্তির শীর্ষ কোম্পানিতে ব্যক্তিগত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এটি আমাদের বিনিয়োগ কৌশলের সম্প্রসারণ।

");

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন