ঠাকুরগাঁওয়ের পনির শিল্প: সীমিত বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে উদ্যোক্তারা

বণিক বার্তা প্রতিনিধি ঠাকুরগাঁও

পনির নিয়ে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের মতো ঠাকুরগাঁওয়ের কোনো ঐতিহ্য না থাকলেও বাণিজ্যিক কারণে ইদানীং এ জেলায় দুগ্ধপণ্যটি তৈরিতে কারখানা বাড়ছে। কয়েক বছরের ব্যবধানে জেলাটিতে ২০টি পনির কারখানা চালু হয়েছে। তবে স্থানীয় বা দেশের বাইরে বাজার তৈরি হয়নি এখনো। ঠাকুরগাঁওয়ে তৈরি পনিরের প্রায় পুরোটাই বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্টে।

দিন দিন কারখানার সংখ্যা বাড়ছে। তবে দুধের সংকট থাকায় কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে উৎপাদন করা যাচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। তাছাড়া দেশে এ দুগ্ধপণ্যের বাজারও বেশ ছোট। ফলে প্রতিযোগিতা বেশ তীব্র।

ঠাকুরগাঁও জেলা শহরের রোড বাজার এলাকার হামিম মিল ফুড প্রডাক্ট কারখানার মালিক সাইদুল ইসলাম আড়াই বছর আগে পনির কারখানা স্থাপন করেন। শুরুতে ১২ জন শ্রমিক নিয়ে দৈনিক ১০-১৫ কেজি পনির উৎপাদন হতো তার কারখানায়। তবে বর্তমানে সাতজন শ্রমিক নিয়ে ৭-১০ কেজি উৎপাদন করছেন।

কারণ হিসেবে সাইদুল ইসলাম বলেন, এখন কারাখানা বেড়েছে, ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে গেছে। লাভ কমে যাওয়ায় কারখানা ছোট করে আনতে হয়েছে। যখন শুরু করি তখন জেলায় কারখানা ছিল ১৩টি। এখন ২০টি।

ঠাকুরগাঁওয়ে সাইদুলের মতো ছোট কারখানা রয়েছে ১৩টি। মাঝারি আকারের কারখানা রয়েছে সাতটি। এর মধ্যে শুধু রোড বাজার এলাকাতেই রয়েছে চারটি কারখানা। জেলা শহরের তেলিপাড়া ও নিশ্চিন্তপুর, পুরান বাসস্ট্যান্ড এলাকায়ও বেশ কয়েকটি পনির কারখানা রয়েছে।

মাঝারি আকারের কারখানাগুলোয় ১০ থেকে ৩৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। দৈনিক পনির উৎপাদন হয় ৫০ থেকে ২০০ কেজি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলা শহরের নিশ্চিন্তপুর এলাকায় ১৯৯১ সালে বেসরকারি সংস্থা হ্যাডস স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ দিয়ে একটি পনির কারখানা স্থাপন করে। বেশ কয়েক বছর লোকসান দিয়ে কারখানাটি বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েন। 

স্থানীয় মাসুমা খানমের স্বামী ইয়ার মাহমুদ হ্যাডস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে পনির ব্যবসা সম্পর্কে পরামর্শ নেন। চাকরি সূত্রে ঢাকায় থাকা বড় ছেলে তারিকুল ইসলামকে বিষয়টি জানালে তিনি রাজধানীর কয়েকটি বড় ফাস্টফুড ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ করেন। তারা আগ্রহ দেখালে বাবাকে উদ্যোগটি শুরু করার সম্মতি দেন তরিকুল।

এরপর হ্যাডসের কারখানাটিই ভাড়া নিয়ে ২০১১ সালে ব্যবসা শুরু করেন মাসুমা খানম। চাকরি হারানো ওই নারী শ্রমিকদেরই নিয়োগ দেন তিনি। শুরুর দিকে মাত্র ৫-১০ কেজি পনির উৎপাদন করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। পরবর্তী সময়ে ছেলে তারিকুলের চেষ্টায় ঢাকায় বাজার তৈরি হয়। একপর্যায়ে তারিকুল চাকরি ছেড়ে তার তিন ভাইকে নিয়ে ঢাকায় পনির সরবরাহের কাজে লেগে পড়েন। ফলে দ্রুত বড় হতে থাকে তার ব্যবসা।

মাসুমা খানম এখন ঠাকুরগাঁওয়ের সবচেয়ে বড় পনির কারখানার মালিক। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ লাখ টাকা পুঁজি খাটিয়েছেন তিনি। ৩৪ জন নারী ও পাঁচজন পুরুষ শ্রমিক দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন। একেকজন নারী শ্রমিক মাসে আয় করেন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা।

মাসুমা খানম জানান, তার কারখানায় দৈনিক দুই হাজার লিটার দুধ লাগে। আর পনির উৎপাদন হয় ২০০ কেজি। বেশির ভাগ পনিরই যাচ্ছে রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বাসাবাড়ি ও ফাস্টফুডের দোকানে।

কারখানার সার্বিক অবস্থার বিষয়ে মাসুমা খানম বলেন, ‘আমার স্বামী এ কারখানার উদ্যোগ নেন। পনির তৈরিতে নারীরাই সব কাজ করেন। আমি নিজে থেকে সবকিছু দেখাশোনা করি। তবে দুধের সংকট রয়েছে। খামার ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুধ সংগ্রহ করতে হচ্ছে। প্রতি কেজি দুধ কেনা হয় ৩৫-৪০ টাকায়। উৎপাদিত পনির যাচ্ছে ঢাকায়। সেখানে ছেলেরা বিভিন্ন ফাস্টফুডের দোকানে ৫০০-৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছে। এতে লাভ খুব বেশি হয় না।

উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তারা ব্যবসা করছেন। ব্যাংকঋণ মিলছে না। বেশি সুদের কারণে লাভ কম হচ্ছে। তাছাড়া পনিরের বাজার ছোট হওয়ায় অনেক কারখানা মালিক নিজে ঢাকায় গিয়ে ক্রেতা খুঁজছেন। তাছাড়া দুধের সংকট তো রয়েছেই।

এদিকে ঠাকুরগাঁওয়ে পনির উৎপাদন একটি সম্ভাবনাময় ব্যবসা হিসেবে দেখা দিলেও সঙ্গে বেশকিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। কোনো কারখানাতেই নিজস্ব পানি শোধনাগার নেই। রোড বাজার এলাকার কারখানাগুলোর বর্জ্য পানি নদীতে ফেলা হচ্ছে। অনেকে পানি ফেলতে পুকুর খনন করেছে। দু-একটি কারখানায় করা হয়েছে হাউজ। আবদ্ধ স্থানে এ বর্জ্য পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন