আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও স্বজনতোষী পুঁজিবাদের যোগসূত্র

ড. মইনুল ইসলাম

ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার ও শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার মাধ্যমে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও পুঁজি লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্তনিজের ঘর থেকেদুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’-এর অঙ্গীকার বাস্তবায়ন শুরু করেছেন। প্রথমে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অভিযোগে শেখ হাসিনার নির্দেশে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার পর দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ঢাকার নামিদামি ফুটবল ক্লাবগুলোয় বেআইনিভাবে চালু হওয়া এবং পুলিশের নাকের ডগায় রমরমা ব্যবসা চালানো অনেক ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে র্যাবের ক্র্যাকডাউন, ক্যাসিনো পরিচালনাকারী আওয়ামী যুবলীগের নেতার আসনে গেড়ে বসাগডফাদারদের গ্রেফতার এবং কোটি কোটি টাকা মূল্যের জুয়ার সরঞ্জাম উদ্ঘাটন দেশে-বিদেশে বাংলাদেশীদের মধ্যে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে কয়েকজনের কাছ থেকে কয়েকশ কোটি টাকার এফডিআর ও বিপুল অংকের নগদ টাকা পাওয়ার পর এ গডফাদাররা প্রকৃতপক্ষে কত শত বা হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন এবং কীভাবে, তা নিয়ে সবার মধ্যে প্রচণ্ড কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামের ভাষ্য অনুযায়ী, এ গডফাদারদের সিংহভাগই বিএনপি ও ফ্রিডম পার্টি থেকে যুবলীগে ঢুকে পড়ে গত ১০ বছরে প্রতাপশালী নেতা বনে গেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ ক্র্যাকডাউনকে শেখ হাসিনার নির্দেশে শুরু হওয়াশুদ্ধি অভিযান অভিহিত করে দাবি করেছেন, এ অভিযান আরো সম্প্রসারিত ও জোরদার করা হবে। গত ২ অক্টোবর শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থ যে উইপোকারা খেয়ে ফেলছে, ওদেরকে দমন করতে হবে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই এখন নাকি গোয়েন্দাদের স্ক্যানারে রয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে অদূর ভবিষ্যতে ক্র্যাকডাউন পরিচালিত হবে। দেরিতে হলেও এ শুদ্ধি অভিযান শুরু করার জন্য শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন, তার প্রতি রইল শুভকামনা। বাংলাদেশের উন্নয়নের পথেরএক নম্বর বাধা দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন। এবার যদি এ দুটো জাতীয় মহাদুর্দশার বিরুদ্ধে তার নেতৃত্বে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ সত্যি সত্যিই শুরু হয়, তাহলে তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করবেন।

বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের পতনের পর ১৯৯৬-২০০৮ পর্যায়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনে কোনো ক্ষমতাসীন দল বা জোট পরপর দুবার নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের তাণ্ডব থেকে দলের বা জোটের নেতাকর্মীরা মুক্ত থাকতে না পারার কারণে। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের তিনটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনেই জনগণ সদ্য সাবেক সরকারে আসীন দল বা জোটকে প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু ২০১৪-১৮ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আনায় সাফল্যের কারণে শেখ হাসিনার ওপর জনগণের আস্থা ক্রমেই বেড়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনী প্রচারের পর্যায়ে বোঝা যাচ্ছিল জনগণ শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে বিপুলভাবে বিজয়ী করতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে অর্থনীতির এ সাফল্যের ধারা যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেজন্য বিএনপি-জামায়াতের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি সম্পর্কে জনগণের মনে বিতৃষ্ণা জোরদার হতে থাকায় তাদের জনপ্রিয়তায়ও ভাটার টান শুরু হয়েছে। অর্থনীতির ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো এখন আরো বেশি স্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছে গেছে, যেটা এশিয়ায় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধির হার। সাফল্যের এই শিখরে পৌঁছার পর এবং বিরোধী জোটের কোনো রাজনৈতিক চাপ না থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা যে নিজের ঘর থেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে শুদ্ধি অভিযানটা শুরু করলেন, সেটা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। বিশেষত শুদ্ধি অভিযানে শেখ হাসিনার সাফল্যের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি এজন্য যে তিনি হয়তো এ অভিযানের মাধ্যমে তার জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক সংগ্রামে ঝাঁপ দিয়েছেন। এ দেশে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনকে রুখে দাঁড়ানোর দুঃসাহস দেখানো যেন বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়া, শুদ্ধি অভিযানের কারণে শেখ হাসিনা দুর্নীতিবাজ ও পুঁজি লুটেরাদের টার্গেটে পরিণত হতে পারেন!

১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ও এরশাদ অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এ দেশে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের সুযোগ করে দিয়েছেন তাদের অবৈধ শাসনকে স্থায়ী করার প্রয়োজনে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে আবারো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তানি কায়দার সামরিক বাহিনী ও সিভিল আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত নব্য ঔপনিবেশিক, আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজি লুণ্ঠনমূলক সরকার ব্যবস্থা। সুযোগশিকারি ডানপন্থী ও বামপন্থী নেতা-পাতি নেতাকর্মী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও সিভিল আমলা, পেশাজীবী এবং ব্যবসায়ীদের কেনাবেচার রাজনীতির মাধ্যমে জড়ো করে ক্যান্টনমেন্টে বসেই জিয়াউর রহমান গড়ে তুলেছিলেন তার তল্পিবাহক রাজনৈতিক দল বিএনপি। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে তিনি নিজে দুর্নীতি না করলেও তার আমলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন ক্রমেই বেড়ে গিয়েছিল। এ ব্যাপারে তার আমল নিয়ে দুটো গবেষণা গ্রন্থের দুজন লেখকের কাছে তিনি খোলামেলা স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত বইপেট্রন-ক্লায়েন্ট পলিটিকস অ্যান্ড বিজনেস ইন বাংলাদেশ’-এর লেখক কোসানেকের কাছে প্রদত্ত সাক্ষাত্কারে জিয়া বলেছিলেন, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় উন্নয়নের প্রাথমিক স্তরে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি অপরিহার্য বাস্তবতা (fact of life) কোসানেক বলছেন, জিয়া আমলে ‘Corruption was converted from a crime to a habit.’ ১৯৮২ সালে প্রকাশিত মার্কাস ফ্রান্ডার বইবাংলাদেশ: দ্য ফার্স্ট ডিকেড’-এ তার মতামত আরো খোলামেলা, What Zia has done is to regularize corruption and make it almost necessary for everyone to become involved in it.

১৯৫৭ সালে প্রকাশিত পল বারানের বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ Political Economy of Growth’-

");

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন