স্বীকৃত অর্থনীতিবিদ ত্রয়ী অভিজিৎ ব্যানার্জি, এস্তার দুফলো ও মাইকেল ক্রেমার তাদের উন্নয়ন গবেষণায় র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল (আরসিটি) পদ্ধতি ব্যবহার করে সম্প্রতি অর্থনীতিতে নোবেল জয় করেছেন। চলতি বছর নোবেল কমিটির এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা আর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কেননা আরসিটি পদ্ধতি নিয়ে স্বয়ং কেতাবি অর্থনীতিবিদদের মধ্যেই বাদানুবাদ বিরাজমান। চীনের অনেকেই মনে করেন, নোবেল কমিটি আবারো চীনের উন্নয়ন অভিজ্ঞতাকে উপলব্ধি করতে যারপরনাই ব্যর্থ হয়েছে, আর আরসিটির সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র নেই।
এ পরিপ্রেক্ষিতে কিছু সমালোচকের বয়ান হয়তো ‘আঙ্গুর ফল টক’ প্রবাদের মতোই মনে হতে পারে। তবে শুরু থেকে আজ অব্দি সাহিত্য, চিকিৎসা আর শান্তির জন্য নোবেলে ভূষিত হয়েছেন তিনজন চীনা নাগরিক। অথচ চীনের অর্থনৈতিক ইতিহাস তাত্পর্যপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয়ের প্রস্তাবনা করে, আর উন্নয়ন গবেষণায় আজকাল আরসিটিচালিত পদ্ধতি অনেকটাই পরিত্যক্ত। গবেষকরা অনেকটাই পঞ্চাশের দশকের ধ্রুপদি উন্নয়ন অর্থনীতিবিদদের দেয়া পাণ্ডিত্যের শিক্ষা ভুলতে বসেছেন। যেমন টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক বিকাশ শ্রমসাধ্য, তবে প্রয়োজনীয়।
উদাহরণস্বরূপ, দেশীয় সঞ্চয় বৃদ্ধি করাটা ভীষণ কঠিন, তবে অপরিহার্য। ধ্রুপদি উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ যেমন পেই কাং চাং, রয় এফ হ্যারোড, ইভজি ডোমার ও রবার্ট সলো দেখিয়েছিলেন, দরিদ্র দেশগুলোয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দেশীয় সঞ্চয় বৃদ্ধি করাটা জরুরি। তাদের গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি ছিল মূলত স্বজ্ঞাত; এমনকি কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করা কৃষকরাও জানেন, ভবিষ্যতের উন্নত জীবনের জন্য বর্তমানে কিছু অর্থ সঞ্চয় করা জরুরি, যাতে আরো এক টুকরো জমি কিংবা উন্নত যন্ত্রপাতি কেনা যায়; আর এর মাধ্যমে বর্তমান জমি থেকে আরো বেশি ফলন পাওয়া সম্ভব হয়।
তবে ১৯৭০-এর দশকে তেলসমৃদ্ধ ধনী রাষ্ট্রগুলোর সঞ্চয় আর জাপানের প্রসারিত বৈশ্বিক আর্থিক বাজার নতুন ধারণাকে উসকে দেয়। এর পর থেকে ধরে নেয়া হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেদের দেশীয় মূলধন পুঁজি করতে সাধারণভাবেই আন্তর্জাতিক ঋণের ওপর নির্ভর করতে পারে। যদিও এ তত্ত্ব মোতাবেক অধিক ঋণগ্রহীতা দেশ হিসেবে লাতিন আমেরিকা ভয়াবহ ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও ধারণাটি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।
অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও ১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে চীন তার অংশে দেশীয় সঞ্চয়ের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহের প্রচেষ্টা শুরু করে। বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র রাষ্ট্র হওয়ার পরও ১৯৭৮ সালের পর থেকে চীনের দেশীয় সঞ্চয় কখনই জিডিপির ২০ শতাংশের নিচে নামেনি। এছাড়া দেশটির জাতীয় সঞ্চয় হার ক্রমে বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, বিশেষ করে ২০০৮ সালে চীনের জিডিপি ৫২ শতাংশের চূড়ায় পৌঁছানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে।
একটি দেশকে এর দেশীয় সঞ্চয়ের পুরোপুরি সদ্ব্যবহারের জন্য অবশ্যই নিজের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা লি কুয়ান ইয়ের বিখ্যাত দর্শন হলো, শিল্পায়ন সক্ষমতা ব্যতীত কোনো রাষ্ট্রই বৃহত্তর অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে না। তবে উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করাটা কঠিন। এজন্য রাষ্ট্রকে ঢালাওভাবে উদ্যোক্তাদের অনুপ্রাণিত করার বদলে প্রায়ই ‘মন্দ কাজ’ দিয়ে শুরু করতে হয়।
চীন দুটোই করেছে। এটি শ্রমনিবিড় রফতানি দিয়ে শুরু করে ক্রমান্বয়ে বিশ্বের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ উৎপাদন নেটওয়ার্কের বিকাশ ঘটিয়েছে। আর এটি এখন বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চসংখ্যক উদ্যোক্তাসমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। রাষ্ট্রগুলো কীভাবে শিল্পায়ন করতে পারে এবং নিজস্ব উদ্যোক্তা শ্রেণী তৈরি করতে পারে, তা নিয়ে ১৯৯০-এর দশক থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত খুব কমসংখ্যক উন্নয়ন অর্থনীতিবিদই গবেষণায় নিয়োজিত হয়েছেন।
অনুরূপভাবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজব্যাপী সহযোজন কীভাবে উৎপাদন স্কেলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে—বতর্মান উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়টি উপলব্ধি করতে প্রচণ্ডভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। এক্ষেত্র