এক কিংবদন্তির ভিসি কাহিনী

ড. তোফায়েল আহমেদ

কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লার ভাষায় বললে বলতে হয়, ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি, আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি। আমিও এখানে একজন কিংবদন্তি ভিসির কথা বলার চেষ্টা করছি। তিনি ২৯ বছর বয়সে প্রথম ভিসি হন (১৯২৬)। ৫১ বছর বয়স পর্যন্ত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৫২ সাল পর্যন্ত) একটানা মোট ২৭ বছর ভিসির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিহার রাজ্যের রাজ্যপাল (১৯৫২-৫৭), ভারতের প্রথম মুসলিম উপরাষ্ট্রপতি (১৯৬২-৬৭) ও রাষ্ট্রপতি (১৯৬৭-৬৯) এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি তালিকায় তৃতীয় রাষ্ট্রপতি। তিনি সক্রিয় রাজনীতিবিদ না হলেও রাজনীতি বিযুক্ত ছিলেন না। তার রাজনীতিবিষয়ক মতামতে কোনো লুকোচুরিও ছিল না। তিনি মূলত মনেপ্রাণে ছিলেন একজন সুফি। অন্যদিকে গান্ধীবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, মওলানা ইলিয়াছের তাবলিগি কর্মকাণ্ড এবং দেওবন্দিদের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। কোনো কারণে মওলানা আবুল কালাম আজাদের পছন্দের ব্যক্তি ছিলেন না, আবার মুহাম্মদ আলি জিন্নাহরও ছিলেন ঘোর অপছন্দের ব্যক্তি। তিনি গান্ধীবাদী হয়েও গান্ধীর অনেক মতের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছেন এমন নজির আছে। তিনি আর কেউ নন, দিল্লির জামেয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত উপাচার্য ড. জাকির হোসেন। আজকাল বাংলাদেশ-ভারত সর্বত্র ভিসিদের নিয়ে কেচ্ছা-কাহিনীর কোনো শেষ নেই। তাই মনে হলো ভিসি ড. জাকির হোসেনের জীবনালেখ্য বর্তমানের অনেক ভিসির বিবেকবোধ জাগ্রত করতে কিছুটা প্রাসঙ্গিক হতে পারে।

. জাকির হোসেন ১৮৯৭ সালে হায়দরাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। ১০ বছর বয়সে বাবা ও ১৪ বছর বয়সে মা মারা যান। ১৪ বছর বয়স পর্যন্তইতাওয়া ইসলামিয়ায় মওলানা বাশিরউদ্দিনের তত্ত্বাবধানে কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে আরবি, ফার্সি, উর্দু, ইংরেজি ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশোনা শেষে ১৪-১৫ বছর বয়সে আলিগড় মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল (এমএকিউ) কলেজে ভর্তি হন। প্রথমে ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছা থাকলেও পরে ইংরেজি, দর্শন ও অর্থশাস্ত্র নিয়ে স্নাতক হন। ভালো বৃত্তি নিয়ে আইনশাস্ত্রে এমএ করার সময় আলিগড়ে খণ্ডকালীন প্রভাষকের চাকরি হয়ে যায়। ১৯২০ সালের অক্টোবরে তার নিজের ভাষায় জীবনের এক মহাগুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তিনি নিয়ে ফেলেন। তা হচ্ছে ব্রিটিশরাজের সঙ্গে কোনোরূপ সহায়তা না করা। তার পেছনের ঘটনাটি হচ্ছে, ১২ অক্টোবর মহাত্মা গান্ধী, মওলানা মোহাম্মদ আলী ও মওলানা শওকত আলী আলিগড় শহরে  খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে ছাত্র-যুবকদের সমাবেশে বক্তৃতা করেন। আলিগড় ছিল ব্রিটিশবান্ধব প্রতিষ্ঠান। সভা শেষে আলিগড়ের ছাত্ররা খেলাফত ও অসহযোগ এবং গান্ধীকে নিয়ে নানা কটূক্তি করতে থাকেন। জাকির হোসেন তাতে খুব কষ্ট পান এবং মনে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে থাকে। একদিকে মহৎ কাজে যোগ দেয়ার প্রবল ইচ্ছা, অন্যদিকে আলিগড়ের মায়া ও নিশ্চিত জীবন। পরদিন শহর ছেড়ে যাওয়ার আগে আলি ভ্রাতৃদ্বয় পুনরায় ক্যাম্পাসে আসেন, ছাত্রদের মধ্যে কোনোরূপ সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়ে হতাশায় ও কষ্টে একপর্যায়ে তারা কেঁদে ফেলেন। জাকির হোসেনসহ অনেকের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে। রাতে জাকির হেসেনের প্রচণ্ড জ্বর আসে। তারা কয়েকজন দ্রুত সংগঠিত হয়ে যান। স্কলারশিপ ও চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে জাকির ও বন্ধুদের কয়েকজন দিল্লিতে হাজির হন। হাকিম আজমল খান, আনসারি সাহেব, মওলানা মোহাম্মদ  আলি প্রমুখের কাছে জাকির কথা দেন যে প্রচলিত সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে কোনো জাতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হলে তিনিসহ অনেকে আলিগড় ছেড়ে দেবেন। ২৯ অক্টোবরজামেয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া শুরু হয়। দেওবন্দের মুরুব্বিরা এমওকিউ মসজিদে জামেয়া গঠনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। জামেয়ার নতুন সদস্যরা তখন এমওকিউতেই অবস্থান করতে থাকেন।

হাকিম আজমল খানকে আচার্য, মওলানা মোহাম্মদ আলিকে ভিসি এবং ক্যামব্রিজে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর সতীর্থ ড. এএম খাজাকে অধ্যক্ষ করে তরুণ শিক্ষকদের নিয়ে জামেয়ার যাত্রা হয়। তখন অসহযোগ ও  খেলাফত আন্দোলনের কারণে দেশে টালমাটাল অবস্থা। লেখাপড়ার চেয়ে আন্দোলনের প্রাধান্য বেশি।  খেলাফতের নেতারাই জামেয়ার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। হাকিম আজমল খানই প্রধান দাতা। আন্দোলনের উত্থান-পতনের সঙ্গে জামেয়ার ভাগ্য জড়িয়ে যায়। ছাত্রদের অনেককেই জেলে যেতে হয়। জাকির হোসেন আন্দোলনের সমর্থক হয়ে নিয়মিত খদ্দর পরলেও আইন অমান্য আন্দোলন থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখেন। তিনি শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে কিছু লেখালিখি ও গবেষণায় সময় দেন। ওই সময়ের মধ্যে তিনি প্লেটোর রিপাবলিক এবং Cannan’s Political Economy-এর উর্দু অনুবাদ করেন। দুই বছর পর জামেয়া থেকে জাকির হোসেনকে পিএইচডি প্রোগ্রামে জার্মানি পাঠানো হয়। পরে হামিদ, মুজিব, আবিদ হেসেনসহ জামেয়ার আরো বেশ কয়েকজন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে মিলিত হন। বার্লিনের ভারতীয় মহলে খুব অল্প সময়ে জাকির হোসেনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিমণ্ডলে জার্মান পণ্ডিতদেরও তিনি দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। অনেক জার্মান তরুণী জাকিরের অনুরাগী হয়ে পড়েন। কিন্তু জাকির হোসেন ছিলেন বিবাহিত, মাত্র ১৮ বছর বয়সে শাহজাহান বেগমকে তিনি বিয়ে করেন। তিনি অবাধে সবার সঙ্গে মেলামেশা করতেন, একই সঙ্গে তার বিবাহিত জীবন সম্পর্কেও ছিলেন সজাগ ও বিশ্বস্ত। মুজিব যিনি ছিলেন জাকিরের ছায়াসঙ্গী, সরোজিনী নাইডুর ভাই বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় (চুট্টু), তার বোন নামবিয়ার, হামিদ এবং তার জার্মান স্ত্রী লুভা, জার্মান তরুণী গারডা ফিলিপসব্রনসহ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে জাকির হোসেন তিনটি বছর তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছেন বলে তার জীবনীকার মুজিব মনে করেন।

");

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন