এক সপ্তাহ ধরে কার্যত সুনামি বয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ওপর দিয়ে। ক্রিকেটারদের ১৩ দফা আন্দোলনের রেশ কাটতে না কাটতেই যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত! এক বছর কোনো ধরনের ক্রিকেটে অংশ নিতে পারবেন না বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। আইসিসির দেয়া দুই বছরের নিষেধাজ্ঞার বাকি এক বছর বিশ্ববরেণ্য এ ক্রিকেটারকে দেয়া হয়েছে স্থগিত নিষেধাজ্ঞা। এ সময়ের মধ্যে আইনবহির্ভূত কোনো কিছুতে জড়ালে সাকিবের বাকি এক বছরের নিষেধাজ্ঞাও কার্যকর হবে।
এটা প্রমাণিত যে অন্যায় করেননি, তবে
ভুল করেছিলেন সাকিব। তিন-তিনবার জুয়াড়িদের কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পরও আইসিসি দুর্নীতি দমন
বিভাগকে (আকসু) জানাননি সাকিব। আইসিসির আইনে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জুয়াড়িদের দেয়া
তথ্য গোপন করার শাস্তি ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত। আক্কেল সেলামির বড় খেসারত
সাকিবকে তো বটেই, দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেটকেও। আমাদের ক্রিকেট কতখানি সাকিবনির্ভর, সেটা
অনুধাবন করার জন্য প্রয়োজন পড়ে না বিশেষজ্ঞ হওয়ার। সর্বশেষ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যে
তিনটি ম্যাচ জিতেছিল, তার সবগুলোই সাকিবের কল্যাণে। অন্তত নিকট ভবিষ্যতেও যে একজন সাকিব
পাওয়া যাবে না, এটা নিশ্চিত। গত মঙ্গলবার অপরাধীর চেহারা নিয়ে নিজের দায় স্বীকার করে
নিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ভরসা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই
যে ভুল, এটা কি শুধু ব্যক্তি সাকিবের?
একই সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড
সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন খুব বড় মুখ করে বললেন, ‘সাকিব সাক্ষী।
সে এখানেই আছে। সাকিবের এ বিষয়টা কখন কীভাবে শুরু হয়েছিল, আইসিসি
দুর্নীতি দমন বিভাগ কী করেছিল,
আমরা তার কিছুই জানতাম না।’ দায় মাথা পেতে
নিলেন সাকিব। কিছুই না জানার কথা জানিয়ে শ্বেত-শুভ্র হয়ে বীরদর্পে বেরিয়ে এলেন বোর্ড
প্রধান।
হালে খুবই কড়াকড়ি করছে আইসিসির
দুর্নীতি দমন বিভাগ। ফিক্সিংয়ের দায়ে মোহাম্মদ আশরাফুল পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ
হওয়ার পরও কেন সতর্ক হননি বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা? দেশের ক্রিকেটারদের সতর্কতার জন্য, সর্বোপরি
ক্রিকেটারদের মনিটরিং করার জন্য কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বিসিবির তরফ থেকে? এ
প্রশ্নগুলোর জবাব কে দেবে? কেননা বাংলাদেশ ক্রিকেটের অভিভাবক বিসিবি তো কিছুই জানে না! স্বভাবতই
প্রশ্ন উঠছে, দায় শুধুই কি ক্রিকেটারদের, ব্যক্তির, নাকি
একটা অপেশাদার কাঠামোর মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ ক্রিকেট ম্যানেজমেন্টের?
ড্রেসিংরুমে কি ক্রিকেটার ও বোর্ড
কর্তাব্যক্তিদের সম্পর্ক স্বাভাবিক?
খুবই আস্থার সম্পর্ক ক্রিকেটার ও ক্রিকেট
অধিকর্তাদের? সর্বশেষ ক্রিকেটারদের ১৩ দফা দাবি নিয়ে যে আন্দোলন, সেখানে
অনেক বিষয় এসেছে সামনে। বেতন কাঠামোর সঙ্গে ক্রিকেটীয় পরিবেশ নিশ্চিত করা, সর্বোপরি
পাতানো ম্যাচ বন্ধ করার মতো বিষয়গুলো নিয়েও অভিযোগ করেছেন ক্রিকেটাররা। আমাদের
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ড্রেসিংরুম নিয়ে বোর্ড-ক্রিকেটার মুখোমুখি হওয়াটা প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনা। ক্রিকেটে যারা নিয়মিত
সাফল্য পাচ্ছেন, সেই দেশগুলোর ড্রেসিংরুমের দিকে তাকালে পাস নম্বর কি জুটবে বিসিবির?
ভারতকে ক্রিকেট সাফল্যের চূড়ায়
তুলেছিলেন দলটির অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। তার নেতৃত্বে আইসিসি টি২০ বিশ্বকাপ, ওয়ানডে
বিশ্বকাপ শিরোপা ছাড়াও ক্রিকেটের সব ফরম্যাটেই শ্রেষ্ঠত্ব দেখায় ভারত। এ সাফল্যের
রহস্য কী, এমন একটা প্রশ্নের জবাবে ধোনি বলেছিলেন, ‘ড্রেসিংরুমের
শান্তি।’ খেলার মাঠে বিশেষ করে ক্রিকেটে সাফল্য পাওয়ার অন্যতম প্রাক-শর্ত যে
ড্রেসিংরুমে শান্তি, এর চেয়ে বড় সত্যি আর হয় না।
খুব বড় ধরনের সাফল্য না পেলেও
বাংলাদেশের ক্রিকেটের গ্রাফটা ঊর্ধ্বমুখী ছিল বেশ কয়েক বছর। ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে
ক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত শক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনার দৌড়ে যথেষ্টই এগিয়ে গিয়েছিল
বাংলাদেশ। শান্ত ড্রেসিংরুমের সঙ্গে মাশরাফি মর্তুজার দক্ষ নেতৃত্বের সম্মিলন
ক্রিকেটে সুন্দর আগামীকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল বাংলাদেশ। হালে আমাদের ড্রেসিংরুম
যে কতটা উত্তপ্ত ছিল, তার প্রমাণ গত কয়েকদিনের ঘটনা;
যার চূড়ান্ত বিস্ফোরণ দেখেছে গোটা ক্রিকেট
দুনিয়া। ঘরের আগুনে পুড়ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। থামানোর যেন কেউ নেই!
ক্রিকেট অভিভাবক বিসিবিকে অবহিত না
করেই প্রথমে ১১ দফা দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ধর্মঘটের ডাক দেন
বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। ১১ দফার পাল্টা হিসেবে ক্রিকেটারদের কাঠগড়ায় তোলেন বিসিবি
প্রধান নাজমুল হাসান পাপন। ক্রিকেটারদের আন্দোলনের শুরুতে যে ষড়যন্ত্রের কথা
বলেছিলেন, তা থেকে কখনই বেরিয়ে আসেননি বিসিবি প্রধান। ক্রিকেটারদের দাবি মেনে
নেয়ার পরও বলেছেন, ‘আমার কাছে তথ্য ছিল,
ভারত সিরিজ বানচাল হবে।’
আফগানিস্তানের বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্টে
হারের জন্য সাকিবকেই দায়ী করেছেন বিসিবি সভাপতি। তার ভাষায়, ‘আমার
মনে হয় অনূর্ধ্ব-১৯ দল নিয়ে খেললেও আমরা আফগানদের বিপক্ষে জিততে পারতাম। কেননা বড় বড়
দেশও আমাদের এখানে এসে পারে না। জানতে চেয়েছি, যে উইকেট বানালাম, সেখানে
খেলা হয়নি কেন? যাকে জিজ্ঞাসা করি,
সে-ই বলে যে নিজে বোলিং করে এ উইকেট বেছে নিয়েছে সাকিব। আবার ম্যাচ শেষে ও-ই (সাকিব) কেন
বলল যে বাজে উইকেট!’ সব কথার এক কথা,
ক্রিকেটারদের নিয়ে ব্লেম গেমের মধ্যেই আটকে
থেকেছেন বিসিবি প্রধান।
বিসিবি প্রধানের দাবি অনুযায়ী, ভারত
সফর বানচালের ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে তথ্য আছে তার কাছে। কী সেই তথ্য? এটা
কি সাকিব ইস্যু, নাকি আরো ভয়াবহ কিছু?
কিছুই প্রকাশ করেননি তিনি। ‘আইসিসির
শাস্তির ব্যাপারে আমাদের কিছুই করণীয় নেই’—এক কথায় সব দায়মুক্তি!
স্বার্থ ও
‘ইগো’র সংঘাত থেকে কোনোভাবেই মুক্ত হতে না পারলে ক্রিকেটে যে বেশি দূর এগোনো
যায় না, তার প্রমাণ আছে হাতের কাছেই।
অর্থ কতটা অনর্থ বয়ে আনতে পারে, তার
একটা দৃষ্টান্ত কেনিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট। ২০০৩ সালে বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল
খেলেছিল কেনিয়া। ওই সময়টায় বাংলাদেশকে বেশির ভাগ ম্যাচেই হারাত কেনিয়া। ক্রিকেটের
প্রতিষ্ঠিত শক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনায় থাকা দেশটি এখন বিস্মৃতির অতলে। এবারের
বিশ্বকাপ চলাকালে এক সাক্ষাত্কারে কেনিয়া ক্রিকেটের দুর্দশা নিয়ে বলতে গিয়ে
কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান স্টিভ টিকলোর সেই কথাগুলো স্মরণ করা যাক। তার ভাষায়, ‘বিশ্বকাপ
সেমিফাইনালে ওঠাই কাল হলো। বোর্ডে অনেক টাকা আসতে শুরু করল। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল
টাকা উপার্জনের দিকে। বেড়ে গেল দুর্নীতি,
স্বেচ্ছাচারিতা। আর দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল
কেনিয়া ক্রিকেট।’ বোর্ড আর ক্রিকেটারদের দ্বন্দ্ব উইন্ডিজ ক্রিকেটের নৈমিত্তিক একটা
ব্যাপার। প্রায় অর্ধশতাব্দী ক্রিকেট বিশ্ব শাসন করা ক্যারিবীয় ক্রিকেট আজ অতীতের
ছায়াও নয়। বোর্ড-ক্রিকেটার দ্বন্দ্ব জিইয়ে রেখে আর যা-ই হোক মাঠের সাফল্য যে পাওয়া যায় না, তার
বড় প্রমাণ হালের উইন্ডিজ ক্রিকেট।
ঘরের মাঠে আমরা টেস্ট ম্যাচে হেরেছি
আফগানিস্তানের কাছে। বৃষ্টির সুবিধা নিয়েও ম্যাচ বাঁচাতে পারেনি বাংলাদেশ। দিনের
শেষ ১৮ ওভার উইকেটে কাটিয়ে দিতে পারলেও ড্র করতে পারত বাংলাদেশ। উইকেটে ছিলেন
স্বয়ং অধিনায়ক সাকিব। কিন্তু রশিদ খানদের চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞার কাছে হার মানতে হয়েছে
স্বাগতিকদের। অশান্ত ড্রেসিংরুম কত দিনে শান্ত, স্বাভাবিক হবে, আপাতত
তার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। অস্থিরতার প্রভাবও পড়ছে দলের মধ্যে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে
মার্জিত আচরণের জন্য বিশেষ সুনাম আছে মুশফিকুর রহিমের। কয়েক দিন আগে অনুশীলন ম্যাচ
চলাকালীন গ্যালারিতে দর্শকের দিকে তেড়ে গিয়েছিলেন মুশফিক। এর আগে শিশু নির্যাতন, নারী
নির্যাতন, ফিক্সিং—এতসব নেতিবাচক ঘটনার সঙ্গে লাগাতারভাবে জড়িয়েছেন ক্রিকেটাররা। এর বাইরে
উজ্জ্বল ভাবমূর্তি দাঁড় করিয়েছেন মুশফিকের
মতো কয়েকজন। খুব তুচ্ছ কারণে মুশফিককেও মেজাজ হারাতে দেখা গেছে।
গত কয়েক বছরে অনেক তেতো অভিজ্ঞতার
মধ্য দিয়েই যাচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। আইসিসি তথা আকসুর বেঁধে দেয়া সচেতনতামূলক
অনেক শিক্ষা কার্যক্রমেও অংশ নিয়েছেন আমাদের ক্রিকেটাররা। তাতে কী লাভ হয়েছে? একই
ধরনের ভুল বা অপরাধ আসছে ঘুরেফিরেই। ঘরের মাঠে সব অক্রিকেটীয় পরিবেশ আর অপেশাদারিত্ব
জিইয়ে রেখে আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চরম পেশাদার থাকব, নির্ভুল
থাকব—এ
চাওয়াটা কি খুব বেশি হয়ে যায় না?
একটি সহজ প্রশ্ন, কত বছর ধরে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে
ম্যাচ ফিক্সিং চলছে? এর কোনো সদুত্তর হয় না। ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিক্সিং গা-সওয়া। এমন একটা
পরিবেশে বেড়ে ওঠা ক্রিকেটাররা ফিক্সিংয়ে জড়াচ্ছেন না, এটাই
অনেক বড় ব্যাপার। সেখানে জুয়াড়িদের প্রস্তাবের বিষয়টাকে যদি গৌণও বিবেচনা করেন, সে
দায় শুধুই ক্রিকেটারদের। যেহেতু তিনি সাকিব,
বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম আলোচিত নাম, তাই
দায়টা তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধেই।
সাফল্যের সুফল ভোগ করবে সবাই। কিন্তু সংকট দেখা দিলে শুধুই ব্যক্তির দায়!
হালের বাংলাদেশ ক্রিকেটে অনেক টাকা।
ক্রিকেটের কল্যাণে ক্রিকেটসংশ্লিষ্টরাও ভোগ করেন বনেদি স্ট্যাটাস। কিন্তু
ক্রিকেটকে বাইরে রেখে টাকা আর ক্ষমতার খেলায় আটকে পড়লে এর পরিণাম যে ভয়াবহ হতে
পারে, সেটা যত তাড়াতাড়ি সংশ্লিষ্টরা বুঝবেন ততই মঙ্গল। বাংলাদেশে ক্রিকেট
নিয়ে এখন যা চলছে তা এক ভয়ংকর খেলা!
এ মুহূর্তে বোর্ড আর ক্রিকেটারদের অবিশ্বাসের
চোরাস্রোতে ক্ষতবিক্ষত ক্রিকেট। এ আত্মবিনাশী খেলা বন্ধ হোক, এটাই
আমাদের চাওয়া। এখন প্রশ্ন হচ্ছে,
আমাদের এই নির্দোষ চাওয়ার মূল্যই বা কতটুকু!
নাজমুল হক তপন: লেখক
ও সাংবাদিক