পঞ্চাশ ও ষাটের দশক

শামসুল ওয়ারেস

১৯৫৫ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পশ্চিম পার্শ্বে নির্মিত হয় দুটি প্রকল্পঢাকার পাবলিক লাইব্রেরি ভবন এবং অদূরে চারু কারু মহাবিদ্যালয় কমপ্লেক্স। আমেরিকান ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য শিক্ষাপ্রাপ্ত সরকারি স্থপতি মাজহারুল ইসলামের পরিকল্পনায় নির্মিত ওই প্রকল্প দুটি বাংলাদেশে আধুনিক স্থাপত্যের ইতিহাস সূচনা করে। যদিও বর্তমান শতাব্দীর বিশ দশকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই বহু সাধ্য-সাধনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, উদ্ভাবন আন্দোলনের ফল হিসেবে ইউরোপে আধুনিক স্থাপত্য জন্মলাভ করে, তথাপি ১৯৫৫ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের মাটিতে আধুনিক স্থাপত্য ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত উপেক্ষিত। এর জন্য প্রধানত দায়ী ছিল দেশে স্থাপত্য শিক্ষা ব্যবস্থার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি এবং ব্রিটিশ সরকারের সুচিন্তিত উদাসীনতা।

ভারত বিভাগের পরপর ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কমিউনিকেশন বিল্ডিংস অ্যান্ড ইরিগেশন (সিবিঅ্যান্ডআই) মন্ত্রণালয়ে কনসালটিং আর্কিটেক্ট হিসেবে যোগ দেন ব্রিটিশ স্থপতি এডওয়ার্ড চালর্স কোলম্যান হিকস (এফআরআইবিএ) এই সময় ওই মন্ত্রণালয়ে প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন খান বাহাদুর মোহাম্মদ সোলায়মান। তিনি এর আগে দিল্লিতে প্রধান স্থপতি অফিসে হিকসের সঙ্গে কাজ করছিলেন। সেই সূত্রে হিকস কন্ট্রাক্ট সার্ভিসের অধীনে ঢাকায় আসেন। অবশ্য এরই মধ্যেই ওই মন্ত্রণালয়ে ব্রিটিশ স্থপতি রোনাল্ড ম্যাককোনেল কন্ট্রাক্ট সার্ভিসের অধীনে সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট আর্কিটেক্ট পদে কার্যরত ছিলেন। ম্যাককোনেল ভারত বিভাগের আগে স্থপতি জেইনসের সঙ্গে কলকাতা সরকারি স্থাপত্য অফিসে কাজ করছিলেন এবং সেখান থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকার অফিসে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালে হিকসঢাকা রিপ্ল্যানিংনামে একটি মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করেন। প্ল্যানে জমির ব্যবহার অনুযায়ী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, নওয়াবপুর বিপণিবিতান (বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকা), আজিমপুর ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হিকস এরপর রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক, শাহবাগ হোটেল (বর্তমান পি.জি হাসপাতাল), সরকারি নিউমার্কেট, আজিমপুর আবাসিক এস্টেট ইত্যাদি প্রকল্প কাজগুলোর ডিজাইন হাতে নেন। হিকস মোটামুটিভাবে কর্মতত্পর ছিলেন কিন্তু সরকারের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় এবং তার কন্ট্রাক্ট সার্ভিসের মেয়াদ ১৯৫১ সালের মার্চ থেকে বর্ধিত না হওয়ায় দেশ ত্যাগ করেন। কনসালটিং আর্কিটেক্ট পদে উন্নীত হন ম্যাককোনেল। তারপর পর্যায়ক্রমে কনসালটিং আর্কিটেক্ট অ্যান্ড টাউন প্ল্যানার, গভর্নমেন্ট আর্কিটেক্ট ইত্যাদি পদোন্নতি এবং দীর্ঘ ১৯ বছর সরকারের প্রধান স্থপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত থেকে ১৯৭১ সালের নভেম্বরে কন্ট্রাক্ট সার্ভিসের মেয়াদ শেষ করেন। ম্যাককোনেল (আরআইবিএ) তার দীর্ঘ সময়ে বহু সরকারি-বেসরকারি বিল্ডিং ডিজাইন করেন। তার কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলি-ফ্যামিলি হাসপাতাল, ভিকারুন্নেসা নূন বালিকা বিদ্যালয়, হিকসের অসমাপ্ত নিউমার্কেট শাহবাগ হোটেল এবং নয়তলা সচিবালয়।

হিকস ম্যাককোনেলউভয় ব্রিটিশ স্থপতি দেশে স্থাপত্য সৃষ্টিতে মোটেও যত্নবান ছিলেন না অথবা বলা যায় তারা আদতেই নিম্নমানের স্থপতি ছিলেন। তাদের ডিজাইনে নির্মিত পরিবেশ সাধারণ ঘরবাড়ি থেকে কিছুটা উন্নত হলেও কল্পনাশক্তিবিহীন টানা বারান্দার পার্শ্বে একঘেয়ে সারিবদ্ধ কোঠার যোগফলসর্বস্ব ভবনগুলোয় আধুনিক স্থাপত্যের ধ্যান-ধারণার কোনো প্রতিফলন নেই। তাদের স্থাপত্যে স্পেসের ব্যঞ্জনা নেই, কোনো উদ্ভাবনা নেই, অপ্রত্যাশিতের কোনো ভূমিকা নেই, আলো-আঁধারের খেলা নেই, আলো-বাতাস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই, ব্যবহারিক কার্যকারিতা নিয়ে ভাবনা নেই, কংক্রিটের ফ্রেম বা ইটের দেয়ালের কোনো বিশেষ বহিঃপ্রকাশ নেইএকেবারেই অতি সাধারণ নির্বুদ্ধি পরিকল্পনা। ফলে স্থপতিদ্বয়ের কাজ আধুনিক স্থাপত্যের আলো দেখতে পায়নি।

উন্নত স্থাপত্যের বিকাশের পথে রকম অজ্ঞতা অবহেলা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন