উন্নত ব্যবসায়িক পরিবেশের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি

মামুন রশীদ

বিশ্বব্যাংকেরইজ অব ডুয়িং বিজনেস ২০২০’-এ আট ধাপ এগিয়ে ১৯০টি দেশের মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম। আমাদের নিকট-প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত অবশ্য আগের তুলনায় ১৪ ধাপ এগিয়ে তালিকার ৬৩তম স্থানে উঠে এসেছে, আর ২৮ ধাপ এগিয়ে পাকিস্তানের অবস্থান ১০৮তম। বাংলাদেশ সম্পত্তি নিবন্ধন ও এনফোর্সিং কন্ট্রাক্ট বা চুক্তি বাস্তবায়ন সূচকে সবচেয়ে দুর্বলতম অবস্থানে। প্রতিবেদন অনুসারে, সম্পত্তি নিবন্ধন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৪তম এবং চুক্তি বাস্তবায়ন সূচকে ১৮৯তম। সংখ্যাগুলো ব্যবসার মূলে নিহিত সমস্যা, যেমন নিয়ন্ত্রক অস্পষ্টতা, সংকটাপন্ন বিনিয়োগ পরিবেশ এবং দুর্বল মূলধন ও আর্থিক কাঠামোকে চিত্রিত করে।

বৈশ্বিকভাবে না হলেও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে আমাদের ব্যবসার পরিসর বড় হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের রোজকার ব্যবসা সম্পাদনের জন্য কেবল কার্যকরী মূলধন তহবিলের প্রয়োজন পড়ে না, বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নতুন ব্যবসার পাশাপাশি চলমান ব্যবসার পরিসর বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন পড়ে ইকুইটি মূলধনের। অর্থনীতিতে যে গভীরতা ও তারল্য প্রয়োজন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে এর অভাব রয়েছে। জিডিপি অনুপাতে ২০১৯ সালের জুনে তালিকাভুক্ত দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজার মূলধন ছিল জিডিপির ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৮ সালে যা ছিল ২৮ দশমিক ২ শতাংশ। যেখানে অনেক আগেই আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোয় বাজার মূলধনের পরিমাণ জিডিপির ৫০ শতাংশেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে, আর উন্নত বাজারগুলোয় এটি ১১০ শতাংশের মতো। তাছাড়া পণ্যে বৈচিত্র্যময়তার অভাব বিদ্যমান। শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি আহরণের প্রক্রিয়া খুব দুর্বল। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) প্রাতিষ্ঠানিক অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে ট্রেজারি বন্ড তালিকাভুক্ত করার চেষ্টা করেছিল, যা বাজারে তারল্য ও গভীরতা সৃষ্টিতেও সহায়তা করতে পারত। তবে আমলাতান্ত্রিক বাধা-বিপত্তির জাঁতাকলে পড়ে উদ্যোগটি আর আলোর মুখ দেখেনি। বাংলাদেশের কর ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো একটি জটিল গঠন প্রণালির ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যা তদারকি নিয়ন্ত্রণের ক্ষতি ও চিরকালীন অসম্মতির জন্য একটি সহজ জায়গা তৈরির দিকে ধাবিত করে।

নিয়ন্ত্রক কাঠামোর অস্পষ্টতা সরকারি সংস্থার আচরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া আগাম কোনো ঘোষণা ছাড়া হুটহাট নতুন আইন প্রবর্তন, কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা, পরামর্শ ও জনবিতর্ক ব্যতীত বিদ্যমান আইন সংশোধন, নির্ভরযোগ্য নির্দেশিকার অনুপস্থিতি, নামমাত্র নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে অভিযোগ নিষ্পত্তির অনুপস্থিতি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে অনুৎসাহিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশের বাইরে বিকল্প স্থান খুঁজতে বাধ্য করে।

অর্থ আইনের অধ্যাদেশ অনুসারে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য আরোপিত কর মোট আয়ের ২৫ শতাংশ; যা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে সংস্থাগুলোর জন্য আকর্ষণীয় প্রণোদনা যোগ করে। সংকটটি অন্য কোথাও। প্রথমত, বাংলাদেশের বেশির ভাগ কর প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ কর হিসেবে সংগৃহীত হয়। তাছাড়া বতর্মানের প্রণোদনা কাঠামো শুধুই প্রত্যক্ষ করকেন্দ্রিক। দ্বিতীয়ত, আইন ও বিধিমালা বাস্তবায়নের বিষয়গুলো এখনো চ্যালেঞ্জিং।

যখনই কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয় তখন তারা জনসাধারণ ও নিয়ন্ত্রকদের কাছ থেকে উচ্চস্তরের যাচাই-বাছাই এবং সুবিবেচনার মধ্যে থাকে, বিপরীতে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানিগুলো পর্দার আড়ালে থেকেই লাভের জন্য বিদ্যমান ব্যবস্থাকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করতে পারে।

যদি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো তালিকাভুক্তও হয়, তা অগত্যা ব্যবসার জন্য নয়; বরং বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় হবে। তবে এটি ব্যবসার জন্যও ভালো হতে পারে, যেখানে অন্যান্য উৎস থেকে তহবিল প্রাপ্তি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে বাংলাদেশে বহুস্তরযুক্ত লভ্যাংশ অনুদান ব্যবস্থা থেকে এরই মধ্যে সরে আসার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, যা একটি ইতিবাচক দিক। 

ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে আজকাল অনেক কোম্পানি সিঙ্গাপুরে উপযুক্ত একটি কাঠামো স্থাপনের বিষয়টি বিবেচনা করছে এবং সেখানেও তারা তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আঞ্চলিকভাবে ব্যবসার কার্যক্রম বৃদ্ধির পাশাপাশি বৈশ্বিক হয়ে উঠতে আগ্রহী। বাংলাদেশভিত্তিক সংস্থা হিসেবে উল্লিখিত আকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণ তাদের জন্য যারপরনাই চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। 

আমাদের মূলধন চলাচল এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক সীমাবদ্ধ। আমাদের দেশের অভাবনীয় অগ্রগতির সম্ভাবনা জানার পরও কেন বৈশ্বিক বেসরকারি ইকুইটি তহবিলগুলো তাদের সক্ষমতা নিয়ে বাংলাদেশে আসছে না, এটি তার একটি বড় কারণ। অর্থনৈতিক বিকাশের দ্রুতগতি অব্যাহত রাখতে বিষয়টি প্রাসঙ্গিক যে, আইনপ্রণেতাদের উন্মুক্ত চিন্তা ও বৈশ্বিক বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। কেবল মূলধন নিয়ন্ত্রণ পরিবেশকে স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান ও যথাযথ করপোরেট প্রশাসন ব্যবস্থা আনার মাধ্যমে আমরা আমাদের শেয়ারবাজারে আরো বেশি কোম্পানিকে আকর্ষণ করতে পারি। 

উপরে বর্ণিত কারণগুলো বড় সমস্যাগুলোর ক্ষুদ্র চিত্রমাত্র। ব্যবসাগুলো এখনো অযৌক্তিকভাবে উচ্চব্যয়ের মধ্যে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছে। যেমন অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সুবিধা, ব্যাপক দুর্নীতি, কঠোর বহির্মুখী রেমিট্যান্স প্রক্রিয়া, জটিল কর হিসাব পদ্ধতি, বেহিসাবি প্রাক-সংস্থাপন ব্যয় ইত্যাদি।

স্থানীয় ব্যবসায়িক পরিবেশের অপ্রত্যাশিত দিকগুলো সত্ত্বেও আমি আমাদের দেশের কর্মের গতিপথটি ফিরিয়ে আনা সম্পর্কে আশাবাদী হতে চাই এবং আমাদের ব্যবস্থাগত ত্রুটিগুলো সংশোধনের লক্ষ্যে নিজেদের সহজাত দক্ষতা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে চাই। ব্যবসা শুরু করার সূচকে অগ্রগতির পাশাপাশি বিদ্যুৎ সরবরাহ ও তহবিল প্রাপ্তির সূচকে উন্নতি সাধন অবশ্যই ইতিবাচক উদাহরণ।

তবে এক্ষেত্রে পুরোপুরি পুনর্বাসনের প্রয়োজন হবে। এছাড়া প্রয়োজন বর্ধিত রাজস্ব সংগ্রহ ও জবাবদিহিমূলক অটোমেশন ব্যবস্থা, যা কর প্রদানের প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছতা প্রদান করে এবং আন্তর্জাতিক কর পরিকল্পনার পুনর্গঠনের মতো সংস্কারের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হতে পারে। 

যদি এ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে কাজ করা হয় বা কায়মনোবাক্যে পালন করা হয়, তবে শিগগিরই আমরা হয়তো আন্তর্জাতিকভাবে আরো প্রতিযোগিতামূলক বিনিয়োগ প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব।

 

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন