উন্নয়ন অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন

ড. এম এ মোমেন


[গতকালের পর]

দারিদ্র্যের মানচিত্র: অভিজিৎ ও এস্তার দুফলোর পর্যবেক্ষণ, গত তিন দশকে দারিদ্র্যের মানচিত্রে কিছু পরিবর্তন এসেছে। সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে আলট্রা রিচ ও আলট্রা পুওরঅতি গরিব ও অতি ধনী। তাহলে মধ্যবিত্ত মার খেয়ে যাচ্ছে কিনা, এ প্রশ্নে তাদের জবাব: মার খাচ্ছে এবং আমেরিকার মতো দেশে বেশি মার খাচ্ছে। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চীনএসব দেশের দরিদ্ররা দারিদ্র্য থেকে কিছুটা উঠে আসছে। পৃথিবীর নবসৃষ্ট ধনসম্পদ, যা ধনীর কাছে যাচ্ছে, তার ছিটেফোঁটা যেটুকু দরিদ্রদের হাতে আসছে, তারা তা দক্ষভাবে ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। দারিদ্র্য কেবল টাকা-পয়সার টানাটানি নয়, এটি বহুমাত্রিক সমস্যা; যার বহুমাত্রিক নিরসন দরকার।

দারিদ্র্য নিরসনের কোনো সিলভার বুলেট নেই: উন্নয়ন অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: কেমন করে দারিদ্র্য দূর করা যায়? কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত অধ্যাপক জ্যাফ্রি স্যাকস যারা পড়েছেন, তারা জানেন তার প্রধান যুক্তিটি সাহায্যনির্ভর। ধনীর সাহায্যে গরিবের দারিদ্র্যের দুর্গতি ঘুচবে; ধনী দেশের সাহায্য গরিব দেশকে খাদ থেকে টেনে তুলবে। বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদরা দারিদ্র্যকে নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করেছেন, উত্তরণের প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন। কমবেশি সত্য প্রত্যেকটিতে নিহিত রয়েছে, দারিদ্র্যের মার্ক্সীয় ব্যাখ্যাই হোক, কি হালেরএনটাইটেলমেন্ট সমস্যা হোক, দারিদ্র্যের যাতনা একই। অভিজিৎ শৈশব থেকে দারিদ্র্য দেখে, যাতনা ভোগ করে নয়, বড় হয়েছেন।পভার্টি স্টাডিজ আপাতদৃষ্টিতে পুরনো বিষয় মনে হলেও তিনি তা ছাড়েননি। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে এসে নতুন হাতিয়ার আরসিটি র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়ালস ব্যবহার করে অর্থনীতিকে দেখতে শুরু করলেন। তার সঙ্গে যুক্ত হলেন ছাত্রী ও সহকর্মী এস্তার দুফলো। তারা মাঠকে করে নিলেন দারিদ্র্যকে জানার গবেষণাগার। দরিদ্ররা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে বাধাএমন কথাই প্রচলিত। দারিদ্র্য বিমোচনের প্রেসক্রিপশন মেধাবী লোকজন তাদের ধারণা ও এজেন্ডা অনুসারে দিয়ে যাচ্ছেন।

বিমোচনের চর্চাও চলছে বছরের পর বছর ধরে। নতুন নতুন প্যারাডাইস আসছে; পার্টিসিপেশন, এমপাওয়ারমেন্ট, ইনক্লুশন, মেইন স্ট্রিমিং অনেক ধরনের শব্দ উন্নয়ন অভিধানকে সমৃদ্ধ করছে। অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি বলেছে, ‘গরিব মানুষ কী বলছে, কেমন আচরণ করছেন, কীভাবে চিন্তা করছেএসবের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ না দিয়ে আমরা দারিদ্র্যবিরোধী কর্মসূচি হাতে নিতে পারি না। তাছাড়া একক কোনো সিলভার বুলেটে দারিদ্র্যের নিহত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই।

দুর্নীতিতে কিছু আসে যায় না!: গবেষণার বিষয় হিসেবে দুর্নীতি ও প্রবৃদ্ধি, দুর্নীতি ও উন্নয়ন, দুর্নীতি ও পরিবর্তন, দুর্নীতি ও ব্যর্থ রাষ্ট্রএসব নিয়ে গত শতকের ষাটের দশক থেকেই পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজ হয়ে আসছে। সব মিলিয়ে রাষ্ট্র যখন ব্যর্থ, তা বিভিন্নমুখী দুর্নীতির ফলসহজে এ সিদ্ধান্তে আসা যায়। দুর্নীতি প্রবৃদ্ধির অন্তরায়, আবার অতিরিক্ত নীতিপরায়ণতা ও আইনি বাধাও বৃহত্তর প্রকল্প বাস্তবায়নের অন্তরায়। আশির দশকে এটাও প্রচারিত হয়েছে যে, দুর্নীতির অর্থ যদি দেশেই বিনিয়োগ হয়, তা অর্থনীতিতে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে। কিন্তু এ মূলধন দেশের সীমানা পেরিয়ে গেলেই রাষ্ট্র ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রকাশ্য ও গোপনে যারা বাংলাদেশের বাইরে সেকেন্ড হোম তৈরি করেছেন, তাদের মূলধন পাচার করতে হয়েছে এবং এখনো অনেকেরই সেসব বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়মিত দেশীয় অর্থ ও সম্পদ পাচার করতে হচ্ছে। তারা মূলত দেশের রাজনৈতিক, বেসামরিক-সামরিক, ব্যবসায়ী এবং এমনকি সাংস্কৃতিক এলিটও।

নোবেলজয়ী অভিজিৎ পুরস্কারপ্রাপ্তি-পরবর্তী সাক্ষাত্কারে বলেছেন, দুর্নীতির মধ্যে পরিবর্তন ঘটতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার দুর্নীতিগ্রস্ত প্রেসিডেন্ট সুহার্তোর কথা বলেছেন, দুর্নীতির ভীষণ কুখ্যাতি থাকার পরও তিনি ইন্দোনেশিয়ায় পরিবর্তন এনেছেন, সবার জন্য স্কুল এবং সবার জন্য পুষ্টির ওপর তিনি জোর দিয়েছেন।

অভিজিৎ যথার্থই মনে করেন দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদও আশা করেন, তিনি পরের নির্বাচনে জিতবেন, এমপি হবেন, মন্ত্রী হবেন, দুর্নীতির আরো সুযোগ পাবেন। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে এগোনো সম্ভব, পরিবর্তন সম্ভব। অভিজিতের রচনায় এটাও স্পষ্ট, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের সুরক্ষা ভাগের বিনিময়ে তারাই দিয়ে থাকেন, যারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ও দুর্নীতি নির্মূলে কর্মরত।

নিরাপদ অর্থনীতির জন্য পুলিশ সংস্কার: অভিজিৎ ব্যানার্জির অর্থনীতি ও পুলিশি শাসন নিয়ে কথা ও লেখা কয়েকটি বক্তৃতা ও রচনার সারাংশ মোটামুটি এই: অর্থনৈতিক কাঠামোকে দুমড়ে-মুচড়ে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের জন্য যে টাকা বের করে নেন, সেই অবৈধ আয় রক্ষা করতে পুলিশের সঙ্গে গুণ্ডাপাণ্ডার আঁতাত করতে হয় এবং আয়ের একাংশ তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হয়।

পুলিশের কথা ধরুন। ভারতের পুলিশ এখন নিয়ন্ত্রিত হয় ১৮৬১ সালের পুলিশ অ্যাক্টের মাধ্যমে। ১৮৫৭-এর বিদ্রোহের কয়েক বছরের মধ্যে ঘোষিত এ আইন অবশ্যই বিদ্রোহের ঘটনায় প্রভাবিত, যা একে করে তুলেছে অভ্যন্তরীণ সেনা আবরোধের আইন; স্পষ্টতই যার লক্ষ্য আরেকটি বিদ্রোহের সম্ভাবনার মোকাবেলা করা। পুলিশ সেনাবাহিনীর মতোই পোশাক পরে, বুকে ঝুলিয়ে রাখে বহুবর্ণ মেডান।

অভিজিৎ লিখেছেন, মনে করা হয় তাদের দায়িত্ব নাগরিকদের মনে ভয় জাগানো। ভারতবর্ষে পরিচালিত তার নিজের গবেষণায় দেখা যায়, অধিকাংশ মানুষই পুলিশকে ভয় পায়। কারণ পুলিশের ক্ষতি করার ক্ষমতা আছে। সাধারণ মানুষ মনে করে না, পুলিশ তাদের সমস্যায় সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। ফলে অপরাধের যারা ভিকটিম, তাদের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি পুলিশের কাছে যায় না। ১৯০৩ সালে গঠিত পুলিশ কমিশনের প্রতিবেদনেও প্রায় একই চিত্র উঠে এসেছিল। পুলিশ অ্যাক্টের সঙ্গে সঙ্গে তিনি দণ্ডবিধির আধুনিকায়নের কথাও বলেন। রাষ্ট্রকে যত গণতান্ত্রিকই বলা হোক না কেন, রাষ্ট্রের শাসকরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করেন না এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার বিষয়টি কখনো তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় আসে না।

ক্ষুদ্রঋণের বিস্ময়: অভিজিৎ বলছেন, মানুষ ক্ষুদ্রঋণে বিস্ময় প্রত্যাশা করতে পারে, কিন্তু আমাদের তথ্য ও উপাত্ত বলছে বিস্ময় উত্পন্ন করার কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন এ বাস্তবতা। এটা আমাদের সতর্কবার্তাও দেয়মাঠের সাক্ষ্য এ কথা বলে না যে ক্ষুদ্রঋণে বিস্ময় সৃষ্টি করা সম্ভব নয়, তবে এর ওপর আমাদের নির্ভর করা উচিত নয়।

মাইক্রোএন্টারপ্রাইজের ব্যাপারটাও সে রকম। ধারণা করা হয়, এ ধরনের ক্ষুদ্র উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ের উদ্যোক্তা তাদের উদ্যোগ সম্প্রসারিত করার চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু অভিজিেদর গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এ উদ্যোক্তাদের অনেকেই যতটুকু হয়েছে, তাতেই সন্তুষ্ট; আর এটাই তাদের মুখ্য কাজও নয়।

মাইক্রোএন্টারপ্রাইজের ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা অত্যন্ত কম। দক্ষতা খুবই জরুরি। তবুও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা যথেষ্ট বাড়ানো সম্ভব নয়। মানতে হবে এগুলো ছোট প্রতিষ্ঠান এবং এখান থেকে যে সঞ্চয় সৃষ্টি হবে, তাও বড় কাজের জন্য অপর্যাপ্ত। উৎপাদনশীলতা একটি বড় বিষয়, অন্তর্গত গাঠনিক কারণেই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে তা কম হতে বাধ্য।

যদি কোনো একজন নারীকে বড় কোনো কারখানায় বেশি মজুরিতে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়, তিনি অবশ্যই তা গ্রহণ করবেন। কিন্তু সেখানে বড় কারখানা স্থাপন করতে কেউ এগিয়ে আসছেন নাকেন আসছেন না, তারও বহু কারণ রয়েছে।

ক্ষুদ্রঋণের বিকল্প হয়তো নেই এবং ব্যাপারটা এমনও নয় যে, ক্ষুদ্রঋণ প্রদান বন্ধ করে দেয়া হলে অনেক কারখানা স্থাপিত হবে।

আমি মনে করি, সঞ্চয় নিয়ে দরিদ্রের বড় ধরনের উদ্বেগ রয়েছে। তাদের সঞ্চয় দক্ষ উপায়ে ব্যাংকিং পদ্ধতিতে নিয়ে আসার পথ সৃষ্টি করবে সরকার। ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো এ কাজে মধ্যবর্তীর ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু এখন তো তা ভয়ংকর ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। কেউ চাইবে না, তাদের টাকা নিয়ে কেউ পালিয়ে যাক। কিন্তু গ্রামীণ ও ব্র্যাকের মতো সংস্থা সঞ্চয়ের সংগ্রাহক হিসেবে অবশ্যই অনেক সুনাম অর্জন করেছে।

দারিদ্র্যপীড়িত অর্থনীতি?: পৃথিবী যেখানে পদ্ধতিগত অতিকায় সংকটে ভুগছে, সেখানে ক্ষুদ্র একটুখানি মেরামত নিয়ে উৎসব করার যৌক্তিকতা কী? প্রশ্নটি ইঙ্গরিড হারভোল্ড ব্যানগ্র্যাভেন করেছেন। বৈশ্বিক দারিদ্র্য বিমোচনেএক্সপেরিমেন্টাল অ্যাপ্রোচ’-এর সুফল দেখিয়ে তিনজনঅভিজিৎ, এস্তার ও মাইকেল নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেলেন। তাদের নিয়ে মূলধারার সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম এতটাই মাতামাতি শুরু করে দিয়েছে যে, তারা হয়ে উঠেছেন উন্নয়ন অর্থনীতির রকস্টার।

ইঙ্গরিড মনে করছেন, এত হইচই না করে সতর্কতার সঙ্গে তাদের কীর্তির ওজন নেয়া দরকার। তারা যে তথাকথিত আরসিটি (র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়ালস) পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য ওষুধ বাণিজ্যে তার মূল ব্যবহার। দৈবচয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপের (স্কুল, ক্লাস, মা ইত্যাদি) ওপর ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। তাদের ওপর ওষুধের প্রতিক্রিয়া এবং যারা গ্রুপের বাইরে তাদের অবস্থার তুলনামূলক বিবরণী একটি দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। ১৯৯০-এর দশকে অভিজিৎ ও তার দল কেনিয়ার স্কুলে এ পরীক্ষামূলক কাজটি করে এবং কিছু সাফল্য দেখা যায়তাদের হাতিয়ার নগদ অর্থ হস্তান্তর, তারা শিক্ষক অনুপস্থিতি রোধ করতে এবং কমান্ড গ্রুপে ঋণাত্মক চিন্তার প্রবেশ ঘটাতে থাকেন। তাদের এ ধরনের হস্তক্ষেপ ব্যষ্টিক পর্যায়ে কিছু ভালো ফল দেখাতে পারবে সন্দেহ নেই, কিন্তু যে পদ্ধতি সমস্যা সৃষ্টি করছে তা চ্যালেঞ্জ করার মতো কিছুই তাদের হাতে নেই।

ইঙ্গরিড দেখাচ্ছেন খোদ পশ্চিমবঙ্গে ও পাকিস্তানের সিন্ধুতে আরসিটির ধারে কাছে না গিয়ে  সোজাসুজি অতি দরিদ্রের কাছে সম্পদ হস্তান্তর করলে দ্রুত তার অবস্থার উন্নতি ঘটতে থাকে। সুতরাং সাক্ষ্যভিত্তিক নীতি আর আরসিটির প্যাকেজটা খুলে নতুন করে আবার প্যাকেট করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।র্যান্ডমিস্টদের হাতে বৃহত্তর বৈশ্বিক সংকটের মোকাবেলার হাতিয়ার নেই, তাদের পক্ষে কিছু ক্ষুদ্র মেরামতই সম্ভব।

দারিদ্র্য অর্থনীতির কয়েকটি সাম্প্রতিক সেরা গ্রন্থ

সর্বশেষ সর্বাধিক আলোচিতপুওর ইকোনমিকস

");

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন