শিল্প-কারখানায় দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ

মো. আকতারুল ইসলাম

পরিপাটি কক্ষ, দেয়ালে রঙিন দৃশ্যের মনহরা পোস্টার, খেলনাগুলো গুছিয়ে রাখা, লাল রঙের বিছানা, কোলবালিশে পা জড়িয়ে মধ্যদুপুরে দিবানিদ্রায় নিমজ্জিত ফুটফুটে পাঁচ-ছয়টি শিশু। আদর-যত্নে শিশুগুলোকে সুখনিদ্রায় পৌঁছে দিয়ে বসে রয়েছেন একজন নারী। এমনই চোখজুড়ানো দৃশ্য সাভারের আশুলিয়ায় দেবনিয়ার গ্রুপের একটি পোশাক কারখানার নিচতলার ডে-কেয়ার সেন্টারের। এমনই ডে-কেয়ার সেন্টার তেজগাঁও এলাকায় কানিজ গার্মেন্টস এবং ফতুল্লার বিকেএমইএ ডে-কেয়ার সেন্টার।

দেড় যুগ আগেও পোশাক কারখানায় নিয়োজিত কর্মী মায়েদের সন্তানের জন্য অতি প্রয়োজনীয় বিষয়টি অনেকের মাথায় আসেনি। অথচ কর্মজীবী মায়ের শিশুর জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার নারীর সামগ্রিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে জড়িত। সন্তানকে রাখার অসুবিধার কারণে নগরায়িত একক পরিবারের অনেক কর্মজীবী মাকে কর্মক্ষেত্র ছেড়ে দিতে হয়। এতে তার নির্দিষ্ট অর্থ উপার্জন থেমে যায়। পরিবারের ওপর চাপ পড়ে। পরিবারে তার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কিছুটা কমে যায়। সন্তানের লালন-পালন, দেখাশোনার সুবিধার্থে যখন কর্মজীবী মা চাকরি ছেড়ে দেন, তখন ওই প্রতিষ্ঠান একজন দক্ষ কর্মী হারায়। ওই স্থান পূরণে নতুন কর্মীদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দিতে আর্থিক ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রভাব ফেলে, ফলে উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এসব নানা গুরুত্বপূর্ণ দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার শ্রম আইন ৯৮ ধারায় কারখানার শিশুকক্ষ স্থাপনের বিষয়টি সংযুক্ত করে। এতে বলা হয়েছে, একটি অফিসে বা কারখানায় ৪০ জন বা এর বেশি নারী থাকলে এবং তাদের ছয় বছরের কম বয়সী শিশু থাকলে তাদের সুবিধার্থে কর্মক্ষেত্রে একটি শিশুকক্ষ স্থাপন করতে হবে।

একটি শিশুর ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ এবং দুই বছর পর্যন্ত স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে মায়ের দুধ খাওয়ানো হলে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। একটি শিশু ছয় মাস পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবারের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করে। এ সময় সন্তানকে বাসায় রেখে কর্মজীবী মা কর্মক্ষেত্রে থাকলে তার শিশুটি মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত হয়। মায়ের দুধ খাওয়ার ঘাটতির কারণে পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। শিশু থাকে জীবনঝুঁকিতে। বাসায় হোক অথবা কর্মস্থলে হোক, মায়ের যত্নে থাকলে শিশুর এ জীবনঝুঁকি থাকে না। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ অ্যান্ড হিউমেন ডেভেলপমেন্টের গবেষণায় দেখা যায়, একটি ডে-কেয়ার সেন্টার যদি মানসম্মত হয়, তবে শিশুর যত্নের পাশাপাশি তার বুদ্ধিবৃত্তিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়াও ডে-কেয়ারে না থাকলে শিশুদের সামাজিকতা, শিক্ষা, অন্য শিশুদের সঙ্গে মানিয়ে চলা ইত্যাদি বিষয় ঘরে বসে দাদি-নানি বা আয়ার কাছে পাওয়া সহজ হয় না।

শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান সম্প্রতি মাদারস অ্যাট ওয়ার্ক আয়োজিত এক ওরিয়েন্টেশন কর্মসূচিতে শ্রম পরিদর্শকদের গার্মেন্টস কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার এবং মাতৃদুগ্ধ কর্নার স্থাপনে কর্মী মায়ের সন্তানদের জন্য সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিতের নির্দেশ দেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, শ্রম আইন এবং শ্রম বিধিমালায় মাতৃত্বকালীন সুবিধা এবং শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়টি যুক্ত করেছে বর্তমান সরকার। অন্যদিকে জাতীয় মহিলা সংস্থার মাধ্যমেও সরকার গার্মেন্টস কারখানার নারী শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ কর্মসূচির দ্বিতীয় পর্যায়ে গার্মেন্টস কারখানার নারী শ্রমিকদের এক থেকে ছয় বছর বয়সের সন্তানদের জন্য ১০টি থেকে ১৫টি ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করেছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে, ১ হাজার ৩৫০ জন শিশুকে সুস্থ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, অক্ষর জ্ঞানদান, অভ্যন্তরীণ খেলাধুলা ও অন্যান্য বিনোদনমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা। এ কর্মসূচি ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। আন্তর্জাতিক বাজারের বায়ারদের চাপ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিষয় মাথায় রেখে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপনে গার্মেন্টস মালিকদের মধ্যেও আগ্রহ বেড়েছে।

গার্মেন্টস শিল্পে কমপ্লায়েন্স এবং গ্রিন ফ্যাক্টরি বাড়ছে, প্লাটিনাম সার্টিফিকেট পেয়েছে বেশকিছু কারখানা। এসব কমপ্লায়েন্স কারখানাগুলোয় সব ধরনের আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ডে-কেয়ার সেন্টারের সংখ্যাও বাড়ছে। বাংলাদেশে পোশাক উৎপাদন ও রফতানির বড় সংগঠন বিজিএমইএ সূত্র থেকে জানা যায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ১ হাজার ৬২৭টি কারখানা পরিদর্শন করা হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ২২৮টি কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার পাওয়া গেছে, যা শতকরা ৭৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। অন্যদিকে নিটওয়্যার উৎপাদন এবং রফতানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ সূত্র থেকে জানা যায়, নিটওয়্যার কম্পোজিট কারখানায় শতভাগ ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে। তাদের কম্পোজিট কারখানার সংখ্যা ৩৫০। আর যেসব কারখানায় স্যুয়িং, ডায়িং ও নিটিং শাখা রয়েছে, সেসবের ৫৫ শতাংশ কারখানায় ডে কেয়ার সেন্টার রয়েছে। আর কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, সব খাত মিলে এ পর্যন্ত ৪ হাজার ৯০৭টি কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।

তবে গার্মেন্টস কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন এবং ব্যবহার বিষয়ে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, বড় কারখানাগুলোর সবটাতেই ডে-কেয়ার সেন্টার আছে। তার মধ্যে বেশির ভাগই ব্যবহার হয় না। কোনো কোনো কারখানার ডে-কেয়ার সেন্টার খেলনা দিয়ে সাজিয়ে রাখলেও শিশুদের দেখা-শোনার জন্য দক্ষ আয়া নেই। অনেক সময় খাবার খরচসহ যাবতীয় খরচের চিন্তা করে কারখানার মালিকপক্ষ সেখানে শিশু রাখতে অনীহা প্রকাশ করেন। অডিট হওয়ার সংবাদ পেলে কিংবা বিদেশী বায়ারদের দেখানোর জন্য কর্তৃপক্ষ দু-চারটি করে শিশু এনে সেখানে রাখে। দেখায় সব ঠিকঠাক চলছে। অনেক কারখানায় শিশুদের দুপুরের খাবার দেয় না, শুধু বিকালের নাশতা দেয়। অন্যদিকে কারখানার অগ্নিদুর্ঘটনার আশঙ্কাসহ নানা কারণে শ্রমিকরাও তাদের শিশুকে ডে-কেয়ার সেন্টারে রাখতে আগ্রহী হন না।

শিল্প উন্নয়নের স্বার্থে, উৎপাদনের স্বার্থে মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষকে ডে-কেয়ার সেন্টারের উপযোগিতা বুঝতে হবে। কোনো দক্ষ শ্রমিক যাতে সন্তান জন্মদানের পর সন্তানের যত্ন, নিরাপত্তার কথা ভেবে কাজ ছেড়ে না দেন, সেদিকে খেয়ার রাখতে হবে। কারখানার একজন দক্ষ নারীকর্মী তার শিশুকে সুন্দর একটি ডে-কেয়ার সেন্টারে রাখবে, এটি তার অধিকার। এ অবস্থায় রফতানি আয়ের প্রাণ গার্মেন্টস কারখানার ডে-কেয়ার সেন্টারগুলোয় কর্মজীবী মায়েরা যেন তাদের শিশুদের স্বাচ্ছন্দ্যে রাখতে চান, এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি কর্মজীবী মায়েদের শিশুকে ডে-কেয়ার সেন্টারে রাখার মতো মানসিকতা তৈরি করতে হবে। কারখানার ওয়ার্কার্স পার্টিসিপেশন কমিটিকেও আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। তবেই আর কোনো দক্ষ নারীকর্মী সন্তানের যত্ন আর নিরাপত্তার কথা ভেবে চাকরি ছাড়বেন না। একদিন সব কারখানাতেই আশুলিয়ার ডেবনিয়ার, তেজগাঁওয়ের কানিজ গার্মেন্টস কিংবা ফতুল্লার বিকেএমইএর ডে-কেয়ার সেন্টারের মতো প্রাণোচ্ছল, পরিপাটি, স্বাস্থ্যসম্মত ডে-কেয়ার সেন্টার তৈরি হবে, যেখানে কর্মজীবী মা তার সন্তানকে রেখে নিশ্চিন্তে কাজ করতে যেতে পারবেন। তাই বলা যায়, কল-কারখানায় মানসম্পন্ন ডে-কেয়ার সেন্টার পরোক্ষভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পেছনে, শিল্পের পেছনে সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে দীর্ঘমেয়াদি ও সফল এক বিনিয়োগ।

 

মো. আকতারুল ইসলাম: জনসংযোগ কর্মকর্তা, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন