প্রচলিত ধারার চেয়ে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে আমরা বেশি ভালো করেছি

সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী

ব্যবস্থাপনা পরিচালক

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড

৩২ বছরের অভিজ্ঞ ব্যাংকার সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী বর্তমানে শরিয়াহভিত্তিক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এফএসআইবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। ১৯৮৩ সালে আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে তিনি ব্যাংকিং খাতে ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি আইএফআইসি ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এক দশক কাজ করেছেন। একই বছর তিনি এফএসআইবিএলে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগ দেন এবং ২০১১ সালে ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ মাসের ২৫ তারিখে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২০ বছর পূর্ণ হয়েছে। সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এফএসআইবিএলের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ব্যাংকটির অর্জন, পারফরম্যান্স, ভিশনসহ দেশের ব্যাংকিং খাতের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। সাক্ষাত্‍কার নিয়েছেন মেহেদী হাসান রাহাত

দে শের ব্যাংকিং খাতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২০ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই সুদীর্ঘ পথচলায় আপনাদের অর্জনগুলোর বিষয়ে জানতে চাই।

এ মাসের ২৫ তারিখে আমাদের ২০ বছর পূর্তি হয়েছে। ১৯৯৯ সালে প্রচলিত ধারার বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে আমাদের যাত্রা শুরু। এর ১০ বছর পর আমরা ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করি। সে হিসাবে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে আমাদের ১০ বছর পূর্ণ হয়েছে। প্রচলিত ধারার ব্যাংকিংয়ের তুলনায় ইসলামী ব্যাংকিংয়ে আমাদের পারফরম্যান্স আরো বেশি গতি পেয়েছে। আমরা ফরেন ট্রেড ব্যবসায় আগের চেয়ে ভালো করেছি। কৃষিতে বিনিয়োগ আগের চেয়ে বেড়েছে। রেমিট্যান্স আহরণের দিক থেকেও ভালো করছি। গত পাঁচ বছরের রেমিট্যান্সের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতি বছরই আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯২ কোটি টাকা। এটি আমাদের একটি বিরাট অর্জন। আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তিমত্তার জায়গা আমাদের সার্ভিস। আমরা গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে তাদের আস্থা অর্জনে কাজ করছি। বর্তমানে শহর ও গ্রাম মিলিয়ে আমাদের ১৮০টি শাখা রয়েছে। আমাদের ২০ বছর পূর্তির আগের দিন ১৮১তম শাখার উদ্বোধন হয়েছে। আমাদের প্রায় ২৮টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট রয়েছে, এটিকে ১০০-তে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। সারা দেশে আমাদের ১৫১টির মতো এটিএম বুথ রয়েছে। আমাদের শহর ও গ্রামাঞ্চলের শাখার সংখ্যা প্রায় সমান। বিশেষ করে গ্রামীণ শাখাগুলো থেকে একদিকে আমরা যেমন উল্লেখযোগ্য হারে আমানত পাচ্ছি, আবার সেখানে বিনিয়োগের বিপরীতে এনপিএল (খেলাপি ঋণ) নেই বললেই চলে। আজকে আমরা যে অবস্থানে এসে পৌঁছেছি, এতে আমাদের কর্মীদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। অন্য সব ব্যাংকের মতো আমাদের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এনপিএল। যদিও আমাদের এনপিএলের হার ৫ শতাংশে মধ্যে রয়েছে, কিন্তু আমরা এতে সন্তুষ্ট নই। এটিকে কীভাবে আরো কমিয়ে আনা যায়, সেই চেষ্টা করছি। পাশাপাশি নতুন করে যাতে খেলাপি না হয়, সেদিকেও নজর রাখছি। আর ৬ শতাংশ মুনাফায় আমানত নিয়ে ৯ শতাংশ মুনাফায় বিনিয়োগের বিষয়টি বাস্তবায়নে কিছুটা সময় লাগবে। কারণ এখনো কিন্তু বড় অংকের আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে ১০ থেকে সাড়ে ১০ শতাংশ মুনাফা দিতে হচ্ছে। ফলে এ মুহূর্তে ৯ শতাংশ মুনাফায় বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়। ব্যাংকিং খাতে আগের তুলনায় তারল্য সংকট অনেকটা কেটে গেছে। তারল্যে যে টানাপড়েন ছিল, সেটি অনেকাংশে কমে এসেছে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ অব্যাহত থাকলে এ বছরের শেষ নাগাদ দেশের ব্যাংকিং খাত তারল্য সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে আমি মনে করি। ইসলামী ব্যাংক হিসেবে আমরা আমানতের ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারি। যদিও আমাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ৯০ শতাংশের কিছু বেশি। আশা করছি, এ বছরের নভেম্বরের ভেতর এটি ৯০ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে পারব। যেভাবে আমার এগোচ্ছি, আশা করছি সামনের দিনগুলোয় আমাদের ব্যবসা আরো ভালো হবে।

আপনারা কি বড় আকারের ঋণের পরিবর্তে ছোট ঋণের দিকে ঝুঁকছেন?

আমরা বড় আকারের ঋণ দেয়া বন্ধ করে দিয়েছি এমন নয়। এখনো আমরা বড় আকারের অর্থায়ন করছি। এর পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ঋণে বেশি নজর দিচ্ছি। আমরা মনে করি, আমাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে যদি এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড়াতে পারে, তাহলে দেশের অর্থনীতিও উপকৃত হবে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে কিন্তু কর্মসংস্থানও হচ্ছে। আমরা স্টার্টআপে বিনিয়োগে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কারণ হচ্ছে, এর মাধ্যমে কিন্তু সম্ভাবনাময় তরুণ উদ্যোক্তারা তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে পারছেন। এটি আমাদের আনন্দ দেয়। আগের তুলনায় বর্তমানে আমরা নারী উদ্যোক্তাদের আরো বেশি ঋণ দিচ্ছি। এরই মধ্যে যেসব নারী উদ্যোক্তা আমাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই যথাসময়ে ঋণের টাকা ফেরত দিয়েছেন। দু-একটা ক্ষেত্রে হয়তো সমস্যা হয়েছে, কিন্তু সেটি তেমন কিছু নয়। আমরা কৃষিতেও বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছি। সামনের দিনগুলোয় আমরা কৃষিতে আরো বেশি বিনিয়োগ করব। সবকিছু মিলিয়ে আমরা আমাদের বিনিয়োগ পোর্টফোলিওটিকে আরো বেশি ডাইভার্সিফায়েড করার উদ্যোগ নিয়েছি।

স্বল্পমেয়াদে আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এ কারণে ব্যাংকের পরিবর্তে পুঁজিবাজার থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন করার বিষয়টি জোরালো হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

স্বল্পমেয়াদে আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের কারণে একটা মিসম্যাচ তো হচ্ছেই। বিশ্বের সব দেশেই পুঁজিবাজার থেকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করা হয়ে থাকে। কিন্তু পুঁজিবাজারে তো আর একেবারে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা স্টার্টআপ কোম্পানিকে নিয়ে আসা যাবে না। কারণ পুঁজিবাজারে যারা বিনিয়োগ করেন, তারা কিন্তু কোম্পানির আর্নিংস, রেভিনিউসহ আর্থিক বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে থাকেন। ফলে পুঁজিবাজারে আসার আগে একটি কোম্পানির ন্যূনতম অভিজ্ঞতা ও আর্থিক ভিত্তি দাঁড় করানোর প্রয়োজন রয়েছে। আর এজন্য ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিতেই হবে। তবে যেকোনো দেশের অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এখানে একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার গড়ে উঠলে তা অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

বাজার মূলধনের দিক দিয়ে পুঁজিবাজারে ব্যাংকিং খাতের অবস্থান শীর্ষে। ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকটের একটি পরোক্ষ প্রভাব পুঁজিবাজারেও দেখা গেছে...

পুঁজিবাজারে যে কয়টি খাতে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তার মধ্যে ব্যাংকিং খাত অন্যতম। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাংকগুলোর মুনাফা কেমন হচ্ছে, তারা লভ্যাংশ কেমন দিচ্ছে, এগুলো নিয়ে কিন্তু একটি আগ্রহ সবসময়ই থাকে। বর্তমানে বিনিয়োগকারীরা অনেক সচেতন। তারা ব্যালান্স শিট বিশ্লেষণ করে আর্থিক অবস্থা যাচাই করে শেয়ার কিনে থাকেন। বর্তমানে পুঁজিবাজারে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের দাম পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, অধিকাংশ ব্যাংকের দরই কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই রয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু নীতিসহায়তা দেয়া হয়েছে। আপনারা এ সুবিধা নেয়ার ক্ষেত্রে কতটুকু আগ্রহী?

আমাদের আগ্রহ তো অবশ্যই রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সুবিধা দিয়েছে। আমরা নিজেদের মতো করে সেটি পর্যালোচনা করে দেখছি। বিনিয়োগকৃত অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কীভাবে বিনিয়োগ করা যায়, আমরা সেটি চিন্তাভাবনা করছি।

সার্বিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

সব ব্যাংকের জন্যই মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে খেলাপি ঋণ। বেশকিছু বড় প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়ে গেছে। এর মধ্যে কিছু ইচ্ছাকৃত খেলাপিও রয়েছে। যারা খেলাপি রয়েছে, তাদের ঋণ পরিশোধের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকেও খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আশা করি, সামনের দিনগুলোয় খেলাপি ঋণ আদায়ে গতি বাড়বে।

কয়েক বছর আগেও তো ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল। সেখান থেকে হঠা করে তারল্য সংকট তৈরি হলো কীভাবে?

গত কয়েক বছরে আমাদের এখানে বেশকিছু বড় ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। এগুলোর মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ও চলতি মূলধন খাতে বড় ধরনের অর্থায়ন হয়েছে। আর এটি কাছাকাছি সময়ে হওয়ার কারণে ব্যাংকের তারল্যের ওপর একটি চাপ তৈরি করেছে। তাছাড়া আমানতকারীদের একটি বড় অংশ কিন্তু ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছে। সব মিলিয়েই তারল্য সংকটটি তৈরি হয়েছে।

ভবিষ্যতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে কোন অবস্থানে দেখতে চান?

বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার অনেক বেড়েছে। প্রতিনিয়তই নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এর ফলে ব্যাংকিং কার্যক্রম অনেকটাই ঝামেলামুক্ত ও সহজ হয়েছে। তবে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার কারণে কিন্তু আমাদের কাজও অনেক বেড়ে গেছে। আমি একটি কথা প্রায়ই বলে থাকি যে আগে ব্যাংকাররা কেবল ব্যাংকারই ছিলেন, কিন্তু এখন তাদের আইটি থেকে শুরু করে সবকিছুই জানতে হয়। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি এর নিরাপত্তার দিকটি আমাদের নিশ্চিত করতে হচ্ছে। গ্রাহকরা যাতে শাখায় না গিয়ে ঘরে বসেই সব ধরনের ব্যাংকিং সুবিধা পান, আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি। এফএসআইবিএল ক্লাউড নামে আমরা একটি অ্যাপ চালু করেছি। এর মাধ্যমে গ্রাহকরা ঘরে বসেই অনেক সুবিধা পাচ্ছেন। আমরা গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের প্রত্যাশা, গ্রাহকদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যতে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে জায়গা করে নিতে সমর্থ হব ইনশাআল্লাহ।

 

আপনাকে ধন্যবাদ

বণিক বার্তাকেও ধন্যবাদ। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন