নিবিড় জ্যোৎস্নায় নূপুরে মাতাল

হাসান অরিন্দম

আমি তখন মনে-প্রাণে চেয়েছিলাম সানজানার সংসারটা ভেঙে যাক।

দীর্ঘ সময় পেরিয়েছে, তবু সানজানার সঙ্গে কখনই পুরোপুরি যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি আমার। প্রতি সপ্তাহে কি দুই সপ্তাহে একবার হলেও ওর সঙ্গে কথা হতো। সবাই সাধারণত প্রেম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে, কিন্তু সানজানা আগেই অগ্রিম প্রেমিক জুটিয়ে রেখেছিল। যেবার আইএ পাস করল, সেবার সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে জয়েন করে ইন্তেখাব, ওর প্রেমিকতার এলাকারই ছেলে। সানজানার সঙ্গে লম্বাটে লোকটার বয়সের পার্থক্য কম করে এগারো-বারো বছর। মাঝে মাঝে আমাদের ক্যাম্পাসেও আসত লোকটা। সানজানার মতো দীর্ঘাঙ্গিনী হরিণচোখা সাপিনীর বক্রগতিসম্পন্ন নারীর প্রেমিক যে, তার তো আমাদের চক্ষুশূল হওয়ারই কথা। তবু লোকটার মধ্যে কেমন একটা উদার উদার ভাব ছিল। সে আমাদের সবাইকে ডেকে সিঙাড়া, চা-সিগারেট খাওয়াত। ব্যাপারটা বিশেষত আমার মধ্যে খানিকটা অস্বস্তি সৃষ্টি করলেও আমি বুঝতে দিতাম না। না হলে আমার অপ্রতিভতা ধরা পড়বে। বিশেষ করে সবুজ মাঠে আড্ডার ফাঁকে আমাদের বৃত্তের মধ্যে সানজানাকে পাশে বসিয়ে যখন এক-আধবার লোকটা সানজানার হাত কিংবা কাঁধ স্পর্শ করত, আমার মনে হতো ওকে বলি আপনি এভাবে হাত ধরে প্রেম করতে চাইলে ওকে ঘরে নিয়ে যান, সবার সামনে এগুলো ভালো দেখায় না। তখনই আবার মনে হয় এভাবে বললে আমার নাম একেবারে সঙ্গে সঙ্গে পরাজিতের খাতায় উঠে যাবে। সবাই উল্টো আমাকে নিয়েই হাসাহাসি করবে। আর আমার এই ঈর্ষা নিতান্তই অর্থহীন নিম্নস্তরের।

তবু একটি দিনের দৃশ্য আমাকে সারা রাত ঘুমতে দেয়নি, যতবার চোখের পাতায় ভেসেছে, ততবারই চোখ-জ্বলুনিতে, বুকের খচখচানিতে ছটফট করেছি। প্রাণিবিদ্যার সাইমন বাইনোকুলার গলায় ঝুলিয়ে আর দামি লেন্সযুক্ত ক্যামেরা হাতে বিকাল হওয়ার আগেই কোথায় যেন যাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলে সে জানাল, উত্তর দিকটার জঙ্গলে; ওখানে বেলেহাঁস ছাড়াও বিচিত্র প্রজাতির বক, ডাহুক, মাছরাঙা, শামুকভাঙা, হাড়গিলা এসব পাখি আসে। এই সময়টা ওদের দেখা আর ছবি  তোলার জন্য খুব ভালো। এগুলো তার প্রজেক্ট ওয়ার্কের জন্য কাজে লাগবে।

ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর দিয়ে মিনিট কুড়ি হেঁটে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। এতদিন হলো ক্যাম্পাসে এসেছি, অথচ জায়গাটা দেখা হয়নি। একটা বড় লেকের চারধারজুড়ে জারুল, শিমুল, তমাল, সেগুন প্রভৃতি গাছের সমারোহ। ওদের ভেতর মাঝে মধ্যে কিছু বেতের ঝোপ আছে, আর আছে আকাশছোঁয়া কতক তালগাছ। সাইমন নিয়ে না এলে আমি জানতেই পারতাম না এখানে স্বপ্নের মতো সুন্দর জল-আকাশ বৃক্ষ আর পাখির নির্ভয়-রাজ্য রয়েছে। চর্মচক্ষুতে আমি চারপাশ দেখে, গন্ধ নিয়ে যখন নিজের চোখ আর মন জুড়িয়ে নিচ্ছি, ততক্ষণে বাইনোকুলার গলায় ফেলে সাইমন ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শুরু করেছে। খানিক বাদে নিজের গলা থেকে বাইনোকুলারটা খুলে আমার হাতে দিয়ে বলে, ‘এটা দিয়ে ওই পূর্বপারের দৃশ্যগুলো দেখ, কী অসাধারণ!’

আমি লেন্স ঘুরিয়ে দূরের জায়গাগুলোতে ফোকাস করি। সেখানকার জল, শেওলা, মাছ, ফড়িং, গুল্ম, হেলেঞ্চা, ঘাসফুল, ডাহুক সবই ধরা পড়ছে আমার চোখে। বাইনোকুলারটা সামান্য একটু ঘুরালে হঠাৎ একটা গোলাপি কাপড়ের ওপর আমার দৃষ্টি আটকে যায়। জঙ্গলে নতুন কাপড় কোত্থেকেকোনো মেয়ের ওড়নার মতো লাগছে। আমি আট-দশ পা এগিয়ে গিয়ে ফোকাস নির্দিষ্ট করি। দুজন নরনারী প্রকৃতির ভেতর গভীর মগ্নতায় ডুবে আছে। কিন্তু কারা ওরা। আমি জানতাম বিষয়ে আমার অতি আগ্রহী হওয়াটা ঘোর অন্যায়। তবু আমি না-এগিয়ে পারি না, কারণ একটি বিশেষ সংশয় দূর

");

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন