গ্রাফিতি বললে আমাদের চোখের সামনে সাধারণভাবে দেয়ালচিত্র গোছের প্রতিবাদী শিল্পকর্ম ভেসে ওঠে। কিন্তু শিল্পমাধ্যম হিসেবে গ্রাফিতির ধারণাটি সহজ নয়; এর সংজ্ঞা, ফর্ম, ভূমিকা নিয়ে শিল্প সমালোচকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভিন্নতা রয়েছে। গ্রাফিতি একদিকে যেমন সাংস্কৃতিক চর্চা, তেমনি এটা এক ধরনের নৃতাত্ত্বিক উপাদান, যা প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত মানুষের বিভিন্ন ভাব প্রকাশে ব্যবহূত হচ্ছে। গ্রাফিতির সঙ্গে ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি ও সামাজিক যোগাযোগের এক জটিল সম্পর্ক আছে। মায়া সভ্যতার ক্ষমতার চিত্র, প্রাচীন মিসরের পুরোহিতদের হিজিবিজি আঁকা থেকে লন্ডন কিংবা ঢাকার দেয়ালে আঁকা ছবি-লেখাকে জোড়া দিয়ে একটি সাধারণ সংজ্ঞা তৈরি করা রীতিমতো জটিল কাজ।
ঢাকায় বছর দুয়েক আগে ‘সুবোধ’ গ্রাফিতি সিরিজ বেশ আলোচিত হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার দেয়ালে দেখা গেছে সুবোধকে। ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় এখন পক্ষে না’—দেয়ালের গ্রাফিতির এ বার্তাটি ঢাকার মানুষকে আলোড়িত করেছিল সন্দেহ নেই। নিত্যদিনের নানা সংকটে, অবিচারে মানুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠেছে পালিয়ে যাওয়ার কথা, সময় পক্ষে না থাকার কথা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিশ্চিতভাবে এ সাক্ষ্য দেবে। তবে কালের ক্ষয়ে যেমন সবকিছুই শূন্যে মিলায়, তেমনি ঢাকার দেয়াল থেকে সুবোধও হারিয়েছে। তবে নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারবেন না যে আবার কবে সকালে উঠে নগরবাসী পড়িমড়ি করে কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষায়তনে ছুটতে গিয়ে কোনো দেয়ালে সুবোধের মুখটা দেখতে পাবেন। ‘সুবোধ’ না হয়ে কোনো ‘নির্বোধ’ও হাজির হতে পারে চারপাশের সময়-সমাজকে অনুবাদ করতে। আধুনিক গ্রাফিতির চরিত্রই এমন। সুবোধ সিরিজটি গ্রাফিতি হিসেবে সার্থক; কারণ এর মধ্যে রহস্য আছে, বক্তব্যে নিশ্চিত অর্থবোধক কোনো বাক্য ব্যবহার করা হয়নি। সুবোধ কারো নাম নাকি ধারণা, তাও স্পষ্ট নয়। মানুষ তার নিজের পরিস্থিতি থেকে সুবোধকে অর্থ দিয়েছে, তার কথার ব্যাখ্যা করেছে। গ্রাফিতিতে এ রহস্য থাকে—এ বিষয়ে কিছুক্ষণ পরে আলোচনা হবে।
সুবোধ গ্রাফিতি সিরিজটি সার্থক আরো একটি কারণে, এ সিরিজ ঢাকায় পরবর্তী সময়ে আরো কিছু গ্রাফিতিকে পথ দেখিয়েছে। গত বছর নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে ঢাকার মানুষ এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। এ আন্দোলনের একপর্যায়ে ‘হেলমেট বাহিনী’র হামলার ঘটনা ঘটে। ঢাকার গ্রাফিতি আঁকিয়েরা এ হেলমেট বাহিনীকে ব্যঙ্গ করে আঁকলেন গ্রাফিতি ‘হেলমেট ভাই’। হেলমেটের সঙ্গে হাতুড়ি যোগ করে ‘ডেঞ্জার’ নামে একটি গ্রাফিতিও হয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিকাশ দেশের ছাত্র রাজনীতিতে একটি কৌতূহলোদ্দীপক বাক্য যোগ করেছে গত কয়েক বছরে—‘সহমত ভাই’। নেতা ফেসবুকে যাই বলেন বা লেখেন, তার নিচে কমেন্ট বাক্সে শত-হাজার ভক্ত-অনুসারী লিখে যান ‘সহমত ভাই’। তবে এ সহমতের ধারণাটি কেবল ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ, এমনটা বলা অন্যায্য হবে—ফেসবুক সেলিব্রিটিদের অধিকাংশের কোনো ফেসবুক পোস্টের নিচে গেলেই দেখা যায় ‘সহমত ভাই’, ‘সহমত আপু’ কিংবা ‘সহমত স্যার’ লেখা অসংখ্য কমেন্ট। তবে সমালোচনা আর ব্যঙ্গবিদ্রূপের কারণে সম্ভবত সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের কমেন্টের পরিমাণ কমেছে। এ বিষয়ে অবশ্য নিশ্চিত কোনো জরিপ আমাদের হাতে নেই। সে যা-ই হোক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহমত পোষণ করার এ রীতি বাংলাদেশের সংস্কৃতি, মানুষের মনস্তত্ত্বে নতুন উপাদান যোগ করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। পশ্চিমা দেশ হলে হয়তো এ বিষয়ে মনোবিদরা এতদিনে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলও প্রকাশ করে ফেলতেন। ?