নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা: ১৬ আসামিরই ফাঁসির রায়

বণিক বার্তা অনলাইন

বহুল আলোচিত ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় ১৬ আসামি প্রত্যেকেরই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আজ বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) সকালে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশীদ এ রায় দেন। একই সঙ্গে প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে আর্থিক দণ্ড দেয়া হয়েছে। সেই টাকা আদায় করে ক্ষতিপূরণস্বরূপ নুসরাতের পরিবারকে দেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে।

চাঞ্চল্যকর এ মামলাটিতে মাত্র ৫০ দিনের মাথায় দেয়া হয় চার্জশিট। আর ছয় মাসের মাথায় আজ মামলার রায় ঘোষণা করা হল। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৬ আসামি হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি রুহুল আমিন, সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম, মাদরাসার শিক্ষক আবদুল কাদের, প্রভাষক আফসার উদ্দিন, মাদরাসার ছাত্র নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ যোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি ওরফে তুহিন, আবদুর রহিম শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, মোহাম্মদ শামীম ও মহি উদ্দিন শাকিল।

নুসরাত হত্যা মামলায় বাদীপক্ষে ছিলেন বিচারিক আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর হাফেজ আহমেদ, অ্যাডভোকেট আকরামুজ্জামান ও অ্যাডভোকেট এম শাহ জাহান সাজু। আর আসামিপক্ষে ছিলেন হাইকোর্টের আাইনজীবী অ্যাডভোকেট ফারুক আহমেদ ও এনামুল হক, ফেনী আদালতের সিনিয়র আইনজীবী গিয়াস উদ্দিন নান্নু, কামরুল হাসান, নূরুল ইসলাম, ফরিদ উদ্দিন নয়ন ও মাহফুজুল হক, আহসান কবির বেঙ্গল, সিরাজুল হক মিন্টুসহ ২০ জন আইনজীবী।

এর আগে সকাল ৯টা থেকেই আদালত প্রাঙ্গণে আসামিপক্ষের স্বজন, গণমাধ্যমকর্মী ও শত শত উৎসুক জনতা ভিড় জমাতে শুরু করেন। র‌্যাব ও পুলিশের কড়া নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে ১০টা ৫০ মিনিটে মামলার ১৬ আসামি আদালতে হাজির করা হয়। বেলা ১১টায় বিচারক মো. মামুনুর রশিদ এজলাসে উপস্থিত হয়ে মামলার রায় পড়া শুরু করেন। টানা ১৫ মিনিট ১৭২ পৃষ্ঠার রায়ের মূল অংশ তিন পৃষ্ঠা পাঠ করে এজলাস ত্যাগ করেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, ‘এ মামলার আসামিরা বিভিন্নসময় যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন তা সকল মানবিকতাকে হার মানিয়েছে।’ শুরু থেকেই আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডটি মানুষের সামনে আনার জন্য সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধন্যবাদ জানান বিচারক। 

এ ঘটনায় গাফিলতি করায় সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) তিরষ্কারও করেছেন আদালত। বিচারক মো. মামুনুর রশিদ পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘এ ঘটনায় তৎকালীন ওসি গাফিলতি করেছেন।’ ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের কর্মকাণ্ড আর না ঘটে সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দেন তিনি।

আদালতের এই পর্যবেক্ষণকে ‘যুগান্তকারী’ হিসেবে দেখছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। তারা বলছেন, ‘ছেলেমেয়েরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে যায়। আর সেখানে গিয়ে শিক্ষকের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়, শিক্ষকের লেলিয়ে দেয়া বাহিনীর হাতে মারা যায়। এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেজন্য আদালতের এই পর্যবেক্ষণ যুগান্তকারী হয়ে থাকবে।’

রায়ের পর্যবেক্ষণে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডটি মানুষের সামনে আনার জন্য সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধন্যবাদ জানান বিচারক।

রায় শুনে আদালত চত্বরে আসামিদের স্বজনরা আহাজারি শুরু করেন। আদালত প্রাঙ্গণে হত্যা মামলার আসামি হাফেজ আবদুল কাদেরের পিতা আবুল কাশেম খান, জাবেদ হোসেনের ভাই জাহেদ হোসেন, নুর উদ্দিনের মা রাহেলা বেগম, আবদুর রহিম শরীফের মা নুর নাহার ও  ইফতেখার উদ্দিন রানার পিতা জামাল উদ্দিন প্রকাশ্যে এ রায়ের বিরোধিতা করেন। তারা নুসরাত হত্যা মামলাটি মিথ্যা ও তাদের সন্তানদের বিনা দোষে ফাঁসি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। এসময় স্বজনরা উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকেন।


এদিকে রায় ঘোষণার পর সন্তুষ্টি জানিয়েছেন মামলা বাদী ও নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান, বাবা একেএম মুসা মানিক ও ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান। তারা বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলার বিচারে তিনযুগেরও বেশি সময় লেগেছিল সেখানে নুসরাত খুব ভাগ্যবতী। মাত্র ৬১ কর্মদিসে ও ঘটনার ৬ মাসের মধ্যে তার মামলা বিচার সম্পন্ন হয়। 

মামলা রায়সহ কাগজপত্র এক সাপ্তাহের মধ্যে এটর্নি জেনারেলের দপ্তরে পাঠানো হবে বলেও জানান মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহজাহান সাজু।

অন্যদিকে রায়ে সন্তুষ্ট নন জানিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। নুসরাত হত্যা মামলার আসামি মো. শামিমের আইনজীবী সিরাজুল ইসলাম জানান, হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১২ আসামি জবানবন্দি দিলেও আদালত ১৬ আসামির মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। তাছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ আসামিরা এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি তার মক্কেল মো. শামীমের পক্ষে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানান।

এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সোমবার বিকালে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন ও বাদীপক্ষের খন্ডন শেষে ২৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রায়ের দিন-তারিখ ঘোষণা করেন।

ফেনী জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট হাফেজ আহমেদ জানান, গত ৩০ মে বৃহস্পতিবার ফেনীর আমলি আদালতের বিচারক জাকির হোসাইন নুসরাত হত্যা মামলাটি নারী ও শিশুনির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রেরণের পর ৪৮ কর্মদিবস পর্যন্ত এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা অনুষ্ঠিত হয়। মামলার ৬১তম কর্মদিবসে আলোচিত এ হত্যা মামালার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন আদালত। 

গত ২৭ জুন মামলার বাদী নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এ মামলার ৯২ আসামির মধ্যে নুসরাতের মা শিরিন আক্তার, বাবা একেএম মূসা ও ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হানসহ ৮৭ জন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। বাকী চারজন জনের পক্ষে নথিপত্র আদালতের পেশ করা হলে আদালত তা সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করেন।

নুসরাত হত্যা মামলায় জড়িত থাকার সন্দেহে পুলিশ ও পিবিআই অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ২১ জনকে বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করে। পরে ২৯ মে ১৬ জনকে আসামি করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় নূর হোসেন, আলা উদ্দিন, কেফায়েত উল্যাহ জনি, সাইদুল ও আরিফুল ইসলামের নাম অভিযোগপত্রে রাখেননি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

চলতি বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৬ এপ্রিল ওই মাদরাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগীরা নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। টানা পাঁচদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মারা যান নুসরাত জাহান রাফি।

এর আগে বিভিন্ন সময় আদালতে মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের ও জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন