মৌলিক সংখ্যা দুর্লভ কেন

মেহেদী মাহমুদ চৌধুরী

[পূর্ব প্রকাশের পর]

গণিত ভাবনা পর্ব ১০: বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় কবিতাকেউ কথা রাখেনি। ছাত্রজীবনে যারা আবৃত্তি করতেন, তাদের মুখে অনেক শুনেছি কবিতাটা। সত্যি কথা যে কবিতাটার অনেক পঙিক্ত মনে গেঁথে গেলেও এটা সামগ্রিকভাবে আমাকে কখনো টানেনি। কবিতাটার এমন একটা মনে গেঁথে যাওয়া পঙিক্তবিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম

নীল পদ্ম দুর্লভ। কবিতার কথা অনুসারে কবি ১০৮টা দুর্লভ নীল পদ্ম খুঁজে এনেছেন তার প্রেমিকার জন্য। তবু প্রেমিকা কথা রাখতে পারেনি। তাই কবির আক্ষেপকেউ কথা রাখেনি। যারা কবিতাটা পড়েননি তারা খুব সহজেই ইন্টারনেটে কবিতাটা খুঁজে পাবেন।

সুনীল ১০৮ সংখ্যাটি শুধু কবিতার ছন্দ মেলানোর জন্য ব্যবহার করেননি। এ ১০৮টি নীল পদ্ম পঙিক্তর উৎস রামায়ণের এক চমকপ্রদ উপাখ্যান। কাহিনীতে আছে যে রাম দেবী দুর্গার আশীর্বাদ প্রার্থনার জন্য তুষ্ট করতে পূজার আয়োজন করেন। দুর্গা পূজায় ১০৮টি নীল পদ্ম লাগে। কিন্তু রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজে জোগাড় করতে পেরেছেন ১০৭টি। রাম তাই ১০৮তম পদ্মের বদলে নিজের একটি চোখ উপড়ে দুর্গাকে নিবেদনের জন্য উদ্যত হন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবিতায় এ কারণেই ১০৮ সংখ্যার ব্যবহার। রামায়ণের মতোই সুনীলেরকেউ কথা রাখেনির ১০৮টা নীল পদ্মও প্রকাশ করছে আত্মনিবেদন।

গণিতের আলাপে ১০৮টা নীল পদ্মের কথা কেন টানছি? কারণ এবারের পর্বে এমন এক ধরনের সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করব, যা নীল পদ্মের মতো দুর্লভ। মজার ব্যাপার হলো, এ সংখ্যাগুলো দুর্লভ হলেও অসীম পরিমাণে আছে। তুলনায় ১০৮ একটি সসীম সংখ্যা।

এ দুর্লভ কিন্তু অসীম সংখ্যা হলো আমাদের অতিপরিচিত মৌলিক সংখ্যা। ১, , , ৪ ইত্যাদিকে বলা হয় প্রাকৃতিক সংখ্যা। যে প্রাকৃতিক সংখ্যার উৎপাদক শুধু ১ এবং সেই সংখ্যাটি নিজেই বলা হয় মৌলিক সংখ্যা। যেমন ৩ একটি মৌলিক সংখ্যা। ৩-এর উৎপাদক ১ ও ৩, কারণ ১৩ = ৩। যেহেতু ১ ও ৩ ছাড়া ৩ সংখ্যাটির আর কোনো উৎপাদক নেই, তাই ৩ একটি মৌলিক সংখ্যা। তুলনায় ১০ মৌলিক সংখ্যা নয়, কারণ ১১০ = ১০ আবার ২৫ = ১০। কাজেই ১০-এর উৎপাদক ১, , ৫ ও ১০। উৎপাদকের বৈশিষ্ট্য হলো, কোনো সংখ্যাকে সেই সংখ্যার উৎপাদক দিয়ে ভাগ করলে নিঃশেষে বিভাজ্য হবে। যেমন ৯ সংখ্যাটি ২৭-এর একটি উৎপাদক। কারণ ২৭/৯ = ৩। অর্থাৎ সংখ্যাটি নিঃশেষে বিভাজ্য ও কোনো ভাগশেষ নেই বা শূন্য। পাঠক, বুঝতে না পারলে এখানে একটু বিরতি দিয়ে ভাবুন।

মৌলিক সংখ্যাকে কেন দুর্লভ বলছি, আসুন এবার তার ব্যাখ্যায় আসি। নিচের টেবিলে আমি শূন্য থেকে ১০০ পর্যন্ত মৌলিক সংখ্যাগুলোর একটি তালিকা করেছি। তালিকাটি নিচে দেয়া হলো:

                    মৌলিক সংখ্যা  মোট মৌলিক সংখ্যা

০-১০           ,, ,          

১১-২০       ১১, ১৩, ১৭, ১৯          

২১-৩০       ২৩, ২৯             

৩১-৪০      ৩১, ৩৭            

৪১-৫০      ৪১, ৪৩, ৪৭  

৫১-৬০       ৫৩, ৫৯            

৬১-৭০       ৬১, ৬৭             

৭০-৮০      ৭১,৭৩, ৭৯   

৮১-৯০       ৪৩, ৮৯            

৯১-১০০   ৯৭                       

উপরের টেবিলে দেখতে পাচ্ছি যে প্রথম দিকে আমরা চারটি মৌলিক সংখ্যা পেয়েছি, কিন্তু তা পরে দুই-তিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। একেবারে শেষে ৯১ থেকে ১০০-এর মধ্যে মৌলিক সংখ্যা আছে মাত্র একটি।

পাঠক আসুন, এবার শূন্য থেকে ১ হাজার পর্যন্ত তালিকাটা দেখি:

                  মোট মৌলিক সংখ্যা

০-১০০      ২৫

১০১-২০০               ২১

২০১-৩০০              ১৬ 

৩০১-৪০০              ১৬

৪০১-৫০০              ১৭       

৪০১-৫০০              ১৭

৫০১-৬০০              ১৪

৬০১-৭০০              ১৬

৭০১-৮০০              ১৪

৮০১-৯০০              ১৫

৯০১-১০০০          ১৪

আগ্রহী পাঠক এর মধ্যে কোন কোন সংখ্যা মৌলিক, তা ইন্টারনেটে খুঁজলে সহজেই পেয়ে যাবেন। আমিও সেখান থেকে পেয়েছি, তবে মোট সংখ্যার গণনাটা আমার।

উপরের দুটি টেবিল দেখায় যে আমরা সংখ্যা ধারার যতই উপরের দিকে যাচ্ছি, মৌলিক সংখ্যা প্রাপ্তির পরিমাণ ততই কমে যাচ্ছে। তাই সংখ্যা ধারার উপরের দিকে মৌলিক সংখ্যা দুর্লভ। ভেবে দেখুন আমরা যখন এক লাখ পার হব, তখন মৌলিক সংখ্যার প্রাপ্তির পরিমাণ কেমন কমে যাবে!

মৌলিক সংখ্যা তাইকেউ কথা রাখেনি কবিতার ১০৮টা নীল পদ্মের মতোই সংখ্যা ধারার একপর্যায়ে এসে দুর্লভ হয়ে ওঠে। কিন্তু পাঠকের মনে এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে আমরা সংখ্যা ধারার যতই উপরের দিকে উঠছি, ততই মৌলিক সংখ্যার প্রাপ্তির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তার মানে কি একসময় আর কোনো মৌলিক সংখ্যা পাওয়া যাবে না?

এ প্রশ্নটির একটি উত্তর আছে ইউক্লিডেরএলিমেন্টস নামের গ্রন্থটিতে, যা প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে রচিত। একটি অসাধারণ প্রমাণের মাধ্যমে ইউক্লিড দেখিয়েছেন যে মৌলিক সংখ্যা অসীম, অর্থাৎ এর কোনো শেষ নেই। এ জায়গায় সুনীলের ১০৮টা নীল পদ্মের সঙ্গে মৌলিক সংখ্যার পার্থক্য। মৌলিক সংখ্যা একসময় খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে গেলেও তা আছে অসীম পরিমাণে। অন্যদিকে দুর্লভ নীল পদ্ম আছে সসীমসংখ্যক।

ইউক্লিডের প্রমাণটি এ রকম:

ধরা যাক উপপাদ্যটি সত্যি নয়। মৌলিক সংখ্যা আছে সসীম পরিমাণে। তার মানে একটি সর্ববৃহৎ মৌলিক সংখ্যা থাকবে। আসুন মৌলিক সংখ্যাগুলোর ক্ষুদ্রতম থেকে বৃহত্তম পর্যন্ত একটি তালিকা তৈরি করি। মনে করি, সর্ববৃহৎ মৌলিক সংখ্যাটি হলো। আমাদের তালিকাটা হবে ২, , , , ১১, ১৩, ১৭, ১৯, ২৩, ২৯, ৩১, ৩৭, ৪১, ৪৭...। সব মৌলিক সংখ্যাকে গুণ করে একটি সংখ্যা তৈরি করি। আসুন মনে করি সংখ্যাটি হলো। অর্থাৎ ২১১১৩১৭১৯২৩২৯৩১৩৭৪১৪৭–...– ‘’ = ‘। এ সংখ্যাটি একটি জোড় সংখ্যা, যেহেতু ২ দিয়ে গুণ করা হয়েছে। এবার সংখ্যাটার সঙ্গে ১ যোগ করে একটি নতুন সংখ্যা তৈরি করি। আসুন সংখ্যাটাকে লিখি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন