বিনিয়োগ আকর্ষণের কৌশল খুঁজছে বিডা

আস্থা প্রতিষ্ঠায় সার্বিক পরিবেশের উন্নতি ঘটাতে হবে

বিদেশী বিনিয়োগ আনতে যখন সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে, তখন দেশীয় বিনিয়োগের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। ২০২০ সালের মধ্যে স্থানীয় ও বিদেশী মিলিয়ে প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আকর্ষণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। সন্দেহ নেই, সংশ্লিষ্ট উদ্যোগটি সাধুবাদ পাবে। বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে হলে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি উন্নত অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকা দরকার। বিশ্বব্যাংকের বিচারে গত এক বছরে ব্যবসার পরিবেশের উন্নয়ন ঘটানো সেরা ২০টি দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। ২৪ অক্টোবরডুয়িং বিজনেস ২০২০ প্রতিবেদন প্রকাশের আগে বৈশ্বিক এ ঋণদাতা সংস্থার ওয়েবসাইটে শীর্ষ দেশগুলোর তালিকা প্রকাশ করা হয়। নতুন কোম্পানি নিবন্ধনের খরচ কমেছে। ডিজিটাল সনদ ফি বাতিল করা হয়েছে। ঢাকায় নতুন বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে জামানত অর্ধেক করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরো তার তথ্য সংরক্ষণের আওতা বাড়িয়েছে এবং যেকোনো অংকের ঋণের উপাত্ত সংরক্ষণ করছে। ১০টি নির্দেশক বা মানদণ্ডের ভিত্তিতে ডুয়িং বিজনেস স্কোর গণনা করে বিশ্বব্যাংক। গত বছর ছয়টি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান পিছিয়ে যায়। এগুলো হচ্ছে ব্যবসা শুরু করা, নির্মাণকাজের অনুমোদন, ঋণপ্রাপ্তি, ক্ষুদ্র শেয়ারধারী বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা ও সীমান্ত বাণিজ্য। অন্যদিকে বিদ্যুৎ সংযোগ, সম্পত্তি নিবন্ধন ও কর প্রদান মানদণ্ডে উন্নতি হয়। ব্যবসায়িক চুক্তি কার্যকর বিষয়ে একই অবস্থান আছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করা হলেও সেটি পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না সমন্বয়ের অভাবে।

ব্যবসা সহজীকরণের বাধাগুলো দূরীকরণে জাতীয়ভাবে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা সূচক উন্নতির জন্য বেশকিছু সুপারিশও করেছে। সে অনুযায়ী কিছু পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। এখন প্রয়োজন মাঠপর্যায়ে এ পরিকল্পনাগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন। পরিকল্পনার কার্যকর বাস্তবায়ন বরাবরই বাংলাদেশের সমস্যা। বাস্তবায়ন কার্যকর না হলে র্যাংকিংয়ে উন্নতি হবে না। যে দেশগুলো এক্ষেত্রে এগিয়েছে, দিকনির্দেশনাগুলো তারা মাঠপর্যায়ে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করেছে। বাস্তবায়নের গুণগত মানে দক্ষতা ও গতি বাড়াতে পারলেই বাংলাদেশের উন্নতি কোনো কঠিন বিষয় নয়। এবারের ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদনে ব্যবসার বাণিজ্যিক বিরোধ মেটাতে প্রয়োজনীয় সময় ও ব্যয় এবং এ-সংক্রান্ত আইনি পদ্ধতির গুণগত মানে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। শুধুই বিশ্বব্যাংক নয়, অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীসহ আরো অনেকেই বাংলাদেশের উন্নয়নে মন্থরগতি বা স্থবিরতার কারণ অনুসন্ধান করেছে। সুপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রক্রিয়ার আওতায় বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তথা অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটিয়ে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর দক্ষতা কাজে লাগানো গেলে আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বপ্ন বাস্তবে রূপলাভ করবে, একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে বিশ্বের সম্ভাবনাময় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাণিজ্যিক আইনকানুনে দুর্বলতার জন্য এ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। তারা বলছেন, ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখানে পদে পদে বাধা। চুক্তি আইনের দুর্বলতা, কর আইনে জটিলতা, নিবন্ধন পেতে বিলম্ব এবং গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগে ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের হয়রানিতে পড়তে হয়। অন্যদিকে ঘুষ, দুর্নীতি, বন্দরে দীর্ঘসূত্রতা বাংলাদেশের নিয়মিত সমস্যা। এ কারণে সহজে ব্যবসা করার দিক থেকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এত নিচে। আর এ অবস্থার উত্তরণে দেশের বিদ্যমান বাণিজ্যিক ও করপোরেট আইনে বড় ধরনের সংস্কার আনতে হবে। একথা সত্য, সরকার কিছু কাজ করেছে নীতি সংস্কারের ক্ষেত্রে। সেদিক থেকে বাংলাদেশকে অন্যতম সংস্কারক বলা হচ্ছে। কিন্তু সেসব সংস্কার কতটা সুফল দেবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, একজন বিনিয়োগকারীর কারখানা স্থাপনের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন জমি। দ্বিতীয়ত, পণ্য পরিবহনের জন্য দরকার উন্নত অবকাঠামো। ফলে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ভূমির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও উন্নত অবকাঠামো গড়ে তোলার বিকল্প নেই। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ পেতে কত সময় অপেক্ষা করতে হয় আর ভোগান্তির শিকার হতে হয়, তা ভুক্তভোগীমাত্রই অবগত। বিনিয়োগ বাড়াতে হলে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ, পরিবেশ ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ছাড়পত্রসহ অন্যান্য সুবিধা ওয়ানস্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে দেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে। এর বাইরে বিনিয়োগনীতি সংস্কার করে যুগোপযোগী ও প্রতিযোগিতামূলক করা অপরিহার্য। দক্ষ জনশক্তিও বিনিয়োগের পূর্বশর্ত। এজন্য কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। কাঁচামালের অভাব বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব ফেলে। দেশে বর্তমানে স্থিতিশীলতা থাকলেও আস্থার সংকট কাটানোর উদ্যোগ নেয়া দরকার। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য উন্নত বিমানবন্দর একটি অন্যতম বার্তা। একজন বিদেশী প্রথমে বিমানবন্দর দেখেই সংশ্লিষ্ট দেশ সম্পর্কে ধারণা পান। ফলে বিমানবন্দরের আধুনিকায়ন ও নিরাপত্তা উন্নত না করার বিকল্প নেই। আশার কথা, জমি সংকট সমাধানে অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে কাজ করছে। যত দ্রুত সমস্যার সমাধান করা যায় ততই মঙ্গল। করপোরেট কর কমানোসহ চিহ্নিত সব প্রতিবন্ধকতা দ্রুত দূর করে দেশে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ আসবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবলের অভাব। বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে শুধু সস্তায় শ্রম পাওয়াই যথেষ্ট নয় বাংলাদেশে। এজন্য পেশা ও পণ্যভিত্তিক ডিপ্লোমা প্রযুক্তিবিদ্যা শিক্ষা প্রথমে চালু করা বিনিয়োগ আকর্ষণের পূর্বশর্ত। এছাড়া প্রশিক্ষণ শ্রমশক্তির উৎপাদনশীলতা ও উপার্জনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। বিশ্বব্যাংকের পলিসিতে বলা হয়েছে, জাতীয়ভাবে ডিপ্লোমা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ভূমিকা নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই স্থানীয় ও বিশ্ববাজারের চাহিদাভিত্তিক আধুনিক, সময়োপযোগী, শিল্প-কারখানার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও মানসম্মত ডিপ্লোমা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

আশার কথা হলো, সরকার বেজা গঠনপূর্বক কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করেছে। সেখানে বেশকিছু শিল্পগ্রুপ কারখানা স্থাপনপূর্বক পণ্য উৎপাদন করছে। তৈরি পোশাক শিল্পসহ বড় বড় শিল্প এখন অর্থনৈতিক জোনে যেতে আগ্রহী। তবে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা বেজায় না গেলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা সেখানে যেতে আগ্রহী হবে না, বিষয়টি বিবেচনায় রাখা চাই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন