ই-গভর্ন্যান্স সূচকে আরো উন্নতির প্রত্যাশা

প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে আরো অনেক কাজ করতে হবে

দেশেগুড গভর্ন্যান্স তথা সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকার তার কার্যক্রম এবং সব ধরনের সেবা অনলাইনে দিতে ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স বা ই-গভর্ন্যান্সের পথে বেশ জোরেশোরেই এগোচ্ছে। ই-গভর্ন্যান্স হচ্ছে সরকারি ও জনগণ এবং সরকার ও ব্যবসার মধ্যে সম্পর্ক। এছাড়া সরকারের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র এবং ব্যবসা খাতকে সহজ ও উন্নত করার প্রক্রিয়াও বটে। জাতিসংঘের জরিপও বলছে, -গভর্ন্যান্স সূচকে ভালো করছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগ (ইউএনডেসা) পরিচালিত ই-সরকার ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (ইজিডিআই) অনুযায়ী, বাংলাদেশ শূন্য দশমিক ৪৭৬৩ পয়েন্ট পেয়ে এবং গত দুই জরিপে ৩৫ ধাপ এগিয়ে ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১১৫তম স্থান করে নিয়েছে। ২০১৬ সালের জরিপে এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৪তম, ২০১৪ সালে ১৪৮তম ও ২০১২ সালে ১৫০তম। সরকারের লক্ষ্য এখন আগামী ৬৫ বছরে ই-গভর্ন্যান্স সূচকে বাংলাদেশকে সেরা পঞ্চাশে নিয়ে যাওয়া। ডিজিটাল গভর্নমেন্টের প্রসার ঘটিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন সহজ করতে ২০০১ সাল থেকে দুই বছর পরপর এই জরিপগুলো প্রকাশ করে আসছে জাতিসংঘ। অনলাইন সেবা, টেলিকম অবকাঠামো ও দক্ষ মানবসম্পদএই তিন মাপকাঠি বিবেচনায় ই-গভর্নমেন্ট ডেভেলপমেন্ট সূচক তৈরি করে জাতিসংঘ। এটা ঠিক যে বাংলাদেশে একসময় ই-সার্ভিস বলতে কিছু ছিল না। ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের ফলে এখন ৪০ শতাংশের বেশি সেবা অনলাইনে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ইউনিয়ন ডিজিটাল ইনফরমেশন সেন্টারের সংখ্যা ৫ হাজার ২৭২। ৫০-৬০ লাখ মানুষ প্রতি বছর সেবা নিতে পারছে। কিন্তু এগুলোই যথেষ্ট নয়।

দেশে ইন্টারনেট-বিষয়ক সুশাসন এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। প্রত্যন্ত এলাকাকে এখনো ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আনা যায়নি। ফলে বিশাল একটা জনগোষ্ঠী ইন্টারনেটের বাইরে রয়ে গেছে। শহরের মানুষ যে ডিজিটাল সুবিধা পায়, তা গ্রামের মানুষ খুব একটা পায় না। ফলে একটা বৈষম্য থেকেই যাচ্ছে। এ বৈষম্য কমাতে না পারলে ই- গভর্ন্যান্স পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। দেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট হয়েছে, কিন্তু এখনো ডাটা প্রটেকশন অ্যাক্ট হয়নি। এটা খুবই জরুরি। এটা করা না হলে ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত ডাটা (তথ্য) নিয়ে এ দেশের মানুষকে ভুগতে হবে। ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা তৈরি হয়েছে। আরো যা বাকি রয়েছে, তা দ্রুত করতে পারলে এ দেশের মানুষই অনলাইনে নিরাপদ থেকে এর সুফল ভোগ করতে পারবে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অভিযাত্রায় সারা দেশে পাঁচ হাজার ইউনিয়ন ইনফরমেশন সার্ভিস সেন্টার বা ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর উপরের দিকে আছে ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সেল বা জেলা তথ্য সেল ও ন্যাশনাল ইনফরমেশন সেল বা জাতীয় তথ্য সেল। এসব তথ্যকেন্দ্র ও সেল স্থাপনের সুফল ভোগ করছে জাতি। পোস্ট অফিস বা ডাকঘরও এখন তথ্যপ্রযুক্তিসেবার আওতায় চলে এসেছে। সরকার দেশব্যাপী নয় হাজার গ্রামীণ ডাকঘর এবং প্রায় ৫০০ উপজেলা ডাকঘরকে ই-সেন্টারে পরিণত করেছে। ডাকঘরের মাধ্যমে মোবাইল মানিঅর্ডার ও পোস্টাল ক্যাশ কার্ডসেবা চালু করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এসব পরিষেবার মতো আগামী দিনগুলোয় আরো অনেক নিত্যনতুন সেবা চালু হবে বলে আমরা আশা করি। জেলা সদরের জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয় ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় থেকে গ্রামের লোকজনকে এখন নানা ধরনের ই-সেবা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। দেশকে ডিজিটালকরণের লক্ষ্যে নেয়া পদক্ষেপগুলো মানুষের ঘরে ঘরে প্রযুক্তির সুফল পৌঁছে দেবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। কারণ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে খোদ প্রধানমন্ত্রীর যেমন কার্যকর প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তেমনি তার এ-সংক্রান্ত উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদও অব্যাহতভাবে এ খাতের প্রকল্প-কর্মসূচিগুলোকে নিবিড় নজরে রেখেছেন। সেজন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয় হয়ে উঠেছে সরকারের অন্যতম সক্রিয় মন্ত্রণালয়।

বর্তমান যুগে প্রযুক্তি ব্যবহারে মনোযোগ দেয়া ও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার কোনো বিকল্প কিংবা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। আমাদের সবাইকেই যে যার প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির ব্যবহার জানতে হবে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আইসিটি শিক্ষা চালু করলেই হবে না, এর গুণগত মানও নিশ্চিত করতে হবে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনে। সেই সঙ্গে সাধারণ জনগণকেও আইসিটিমুখী করে তোলার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আবার গ্রাম ও শহর এবং বাংলাদেশ ও অন্যান্য বিকাশমান দেশগুলোর মধ্যে যেন প্রযুক্তিবিষয়ে বিভক্তি বা পার্থক্য না থাকে, আর থাকলেও তা দূর করার দিকে নজর রাখতে হবে। অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে নিয়মিত তদারক থাকতে হবে। এসব প্রকল্পে বরাদ্দ ও তা বাস্তবায়ন যেন বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকে, সেটিও তদারক করাও গুরুত্বপূর্ণ।

সরকার ই-গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠায় যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তার অনেক কিছু পুরোপুরি কার্যকর নয়। সবক্ষেত্রে ই-টেন্ডার চালু করা সম্ভব হয়নি এখনো। মানুষের দোড়গোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে নেয়া উদ্যোগ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। জনপ্রতিনিধিরা এখনো এটি ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি। প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কিছু প্রকল্প চালু হলেও সেগুলোর ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন বিদ্যমান। বাণিজ্য সহজীকরণের লক্ষ্যে নেয়া পদক্ষেপ যেমন ওয়ানস্টপ সার্ভিসের মতো প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। জনগণের সেবা সহজ করার লক্ষ্যে নেয়া উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি সমন্বয়হীনতার কারণে।  সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতেও আমরা পিছিয়ে রয়েছি। টেলি অবকাঠামোয় আমাদের অগ্রগতি ভালো হলেও মানসম্পন্ন উচ্চপর্যায়ের সেবা প্রদানের জন্য এটি কতটা প্রস্তুত, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। অনলাইনে সেবা গ্রহণ ও প্রদানে সরকারি কর্মকর্তা ও নাগরিকরা এখনো ওয়াকিবহাল নয়। এক্ষেত্রে প্রচারণা ও প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রচারণা বাড়ানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে একে গ্রাহকসহায়ক করে গড়ে তোলা আবশ্যক। ই-গভর্ন্যান্স সূচেক বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যত দ্রুত অগ্রগতি করেছে, পরবর্তী ধাপে উন্নীত হতে দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রতিযোগিতা করতে হবে অপেক্ষাকৃত এগিয়ে থাকা দেশের সঙ্গে। স্বভাবতই আমাদের মানসম্পন্ন সেবা প্রদানের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন