১৯৮৭ সালে হায়দরাবাদের ৩৭ বছর বয়সী উদ্যোক্তা রামলিঙ্গ রাজুর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সত্যম কম্পিউটার সার্ভিসেস। ১৯৯১ সালে মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। ১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি ডান অ্যান্ড ব্র্যাডশিটের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে যায় সত্যম। গড়ে ওঠে ডান অ্যান্ড ব্র্যাডশিট সত্যম সফটওয়্যার। ১৯৯৯ সালে নাসডাক ও ২০০১ সালে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয় সত্যম কম্পিউটার। ২০০০ সালে বিশ্বের ১০০ পাইওনিয়ারিং টেক কোম্পানির তালিকায় স্থান পায় সত্যম।
২০০৬ সালে সত্যম কম্পিউটার সার্ভিসেস লিমিটেডের রাজস্ব ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০০৭ সালে আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং এন্ট্রাপ্রেনিউর অব দ্য ইয়ার পুরস্কার পান সত্যমের প্রতিষ্ঠাতা রামলিঙ্গ রাজু। একই বছর ২০১০ ও ২০১৪ সালের ফিফার ফুটবল বিশ্বকাপের অফিশিয়াল আইটি সার্ভিস প্রোভাইডার হওয়ার কনট্রাক্ট পায় সত্যম। ২০০৮ সালে কোম্পানিটির রাজস্ব ছাড়িয়ে যায় ২০০ কোটি ডলার এবং পৃথিবীর ৬৬টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে সত্যমের নেটওয়ার্ক।
২০০৯ সালে আকস্মিকভাবে আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে সত্যম কম্পিউটার। বহু বছরের ম্যানিপুলেশনের কারণে কোম্পানির ব্যালান্স শিটে পাওয়া যায় বড় ধরনের অনিয়ম। ধরা পড়ে কোম্পানির ৭ হাজার কোটি রুপির কেলেঙ্কারি। ব্যালান্স শিটে দেখানো হলেও বাস্তবে ছিল না এ অর্থের অস্তিত্ব। সামলাতে না পেরে রামলিঙ্গ রাজু নিজেই স্বীকার করেন এ কেলেঙ্কারির কথা। স্বীকারোক্তি প্রদানের পর নিজের কোম্পানির চেয়ারম্যান পদ থেকেও সরে দাঁড়ান তিনি।
সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি) ও শেয়ারহোল্ডারদের উদ্দেশে লেখা স্বীকারোক্তিপত্রে রামলিঙ্গ রাজু জানান, তিনি কোম্পানির আয়কে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছেন এবং বিনিয়োগকারীদের বোকা বানিয়েছেন। এতে বলা হয়, ব্যালান্স শিটে দেখানো প্রায় ১০০ কোটি ডলারের (যা ছিল নগদ অর্থের ৯৪ শতাংশ) বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। এ স্বীকারোক্তির পর পরই সত্যমের শেয়ারদরে ধস নামে। কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা আকস্মিকভাবে প্রায় ১৪ হাজার কোটি রুপি (২২০ কোটি ডলার) হারায়।
বহু বছর ধরে অর্থ বাড়িয়ে দেখানোর এ বিষয়গুলো সম্পর্কে রাজু ও তার ভাইরা ঠিকই জানতেন। সত্যমের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) শ্রীনিবাস ভাদলামানি জানান, ব্যালান্স শিটের দিকে তিনি কখনই মনোযোগ দিতেন না। কোম্পানি পরিচালকদেরও এ ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়। কারণ, বহু বছর ধরে চলমান জালিয়তি উন্মোচন করতে তারা ব্যর্থ হয়েছিলেন।
এ ঘটনার পর পরই সত্যমের ওপর সাত বছরের নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করে, সত্যম উপাত্ত চুরি ও কর্মীদের ঘুষ প্রদানের মতো কেলেঙ্কারিতে জড়িত। কেলেঙ্কারির জেরে রামলিঙ্গ রাজু, তার দুই ভাই ও আরো সাতজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের আওতাধীন একটি বিশেষ আদালত। এ ঘটনায় রামলিঙ্গ রাজু ও তার ভাই বি রাম রাজুকে ৫ কোটি রুপি করে জরিমানা করেন আদালত। এছাড়া বাকি অপরাধীদের প্রত্যেককে ২০-২৫ লাখ রুপি করে জরিমানা করা হয়।
সত্যম কেলেঙ্কারি মূলত করপোরেট গভর্ন্যান্স ও নিরীক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত। নিরীক্ষক ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসদের পরোক্ষ সম্মতিতেই এ কেলেঙ্কারি সংঘটিত হয়েছে। কোম্পানি তাদের পর্ষদ, স্টক এক্সচেঞ্জ, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বিনিয়োগকারী ও অন্য স্টেকহোল্ডারদের ভুল তথ্য সরবরাহ করেছে। এর মাধ্যমে মার্কেট ও অন্য স্টেকহোল্ডারদের কাছে কোম্পানির আর্থিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য প্রদান করা হয়েছে। এমনকি কোম্পনির বেসিক ফ্যাক্ট যেমন রাজস্ব, পরিচালন মুনাফা, ইন্টারেস্ট লায়াবিলিটি ও ক্যাশ ব্যালান্স নিয়ে পর্যন্ত ভুল উপাত্ত প্রদান করা হয়।