সাহিত্যে যৌথভাবে নোবেলপ্রাপ্তি নজিরবিহীন

মাছুম বিল্লাহ

যৌন অসদাচরণের এক অভিযোগের তদন্ত নিয়ে জটিলতার কারণে গত বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়নি। আমাদের স্মরণে আছে ২০১৭ সালের শেষ দিকে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানিবিরোধীহ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন’-এর কারণে সারা বিশ্ব কেঁপে ওঠে। সাহিত্যে নোবেল দেয়ার দায়িত্ব যাদের, সেই সুইডিশ একাডেমিতেও লাগে ওই আন্দোলনের ঢেউ। সেই ঢেউ এমনই যে গত বছর সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার প্রদানই স্থগিত হয়ে য়ায়। তাই এবার একসঙ্গে দেয়া হলো ২০১৮ ও ২০১৯ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার। ওই আন্দোলন সূচনার পর একাডেমির সদস্য ক্যাটেরিনা ফ্রস্টেনসনের স্বামী ফরাসি নাগরিক জ্যঁ-ক্লদ আর্নল্টের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এছাড়া স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ফাঁস করে দেয়া, হয়রানিসহ অন্যান্য অভিযোগও ওঠে। ফ্রস্টেনসন ও আর্নল্ট দম্পতির স্টকহোমভিত্তিক সাংস্কৃতিক ক্লাব থেকে সুইডিশ একাডেমি তহবিল পেয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগ ওঠায় পদত্যাগ করেন ফ্রস্টেনসন।

১৯০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১১৬ জন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, যার মধ্যে ১৫তম নারী হিসেবে ২০১৮ সালে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন পোল্যান্ডের সমাজকর্মী ও লেখিকা ওলগা তোকার্তুক। ২০১২ সালে তার নাম নোবেল পুরস্কার মনোনয়নের তালিকায় ছিল। তার লেখা ষষ্ঠ উপন্যাসফ্লাইটস ২০১৮ সালে অর্জন করে ম্যানবুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ। অলগা তোকার্তুকের জন্ম ১৯৬২ সালের ২৯ জানুয়ারি পোল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চলীয় সুলেখোফ শহরে। ১৯৮০ সালে তিনি ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং মনোবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেন। বিচারকদের মতে, তোকার্তুক বহুগুণে গুণান্ব্বিত লেখক। তিনি যেন আকাশের দিকে তাকিয়ে পুরো পৃথিবীকে অবলোকন করেন। তার লেখা বুদ্ধিমত্তায় পূর্ণ এবং চিন্তাশক্তি ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। উপন্যাস ছাড়াও অনুবাদেও যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। রাজনৈতিক সচেতনতা ছাড়াও বুদ্ধিজীবী ও নারীবাদী হিসেবে পোল্যান্ডের রক্ষণশীল মানুষের কাছে বিশেষ স্থানে আসীন ওলগা তোকার্তুক। পোল্যান্ডের সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। মূলত সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন নেতিবাচক বিষয় সূক্ষ্মভাবে উঠে এসেছে তার লেখায়। সারা পৃথিবীতেই রাষ্ট্র নামক যন্ত্র যারা পরিচালনা করেন, তাদের রাষ্ট্র তথা জনগণবিরোধী বহু কার্যকলাপ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য কল্যাণকর হয়ে ওঠে না। তাদের বিরুদ্ধে কলম ধরাও কঠিন কাজ। সে কাজই তিনি করেছেন। তিনি তার কাল্পনিক বিশ্বকোষে আবেগকে জীবনের রূপরেখা হিসেবে নিয়ে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে চেয়েছেন। সুন্দর ও সুখের অন্বেষণে দেশ ও দেশের মানুষের অনাবিল এক আকাশের ছবি সবসময় আঁকতে চেয়েছেন। আর এ কারণেই নিজ দেশের নাগরিকদের কাছে লেখক হিসেবে তার রয়েছে বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা। আর এটি তো স্বাভাবিক, যে লেখক বা সাহিত্যিক জনগণের কথা তার সাহিত্যে তুলে ধরেন, তিনি তো তাদের প্রিয়পাত্র হবেনই। সে রকমই একজন লেখিকা তোকার্তুক।

৫৭ বছর বয়সী লেখিকা তোকার্তুক সাহিত্যের জগতে পা রাখেন কবিতার হাত ধরে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থসিটিজ অব মিররস। ১৯৯৩ সালে তোকার্তুক প্রথম উপন্যাসদ্য জার্নি অব দ্য বুক পিপল প্রকাশিত হয়। সতেরো শতকের প্রেক্ষাপটে লেখা এ উপন্যাসের আখ্যান এক প্রেমিক দম্পতির একটি হারিয়ে যাওয়া বই অন্বেষণ নিয়ে গড়ে ওঠে। এর তিন বছর পর প্রকাশিত হয় প্রাইমিভল অ্যান্ড আদার টাইমস’, যা সারা বিশ্বের সাহিত্যজগেক নাড়া দেয়। এ গ্রন্থে তিনি একটি রহস্যময় গ্রামের চিত্র তুলে ধরেছেন। এতে স্থান পেয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে আশির দশক পর্যন্ত পোল্যান্ডের ইতিহাস। তিনি জীবনের ওপর থেকে জীবনকে দেখেছেন। তার লেখায় প্রজ্ঞা ও বিদ্রূপের  মিশেলে তুলে ধরা হয়েছে অভিবাসন ও সংস্কৃতির রূপান্তর। অভিবাসন বিষয়টিও বর্তমান বিশ্বের এক অমীমাংসিত ও অমানবিক চিত্র। ২০১৮ সালে অস্কারের জন্য মনোনীত অপরাধবিষয়ক চলচ্চিত্রস্পর’-এর জন্য সহলেখক তোকার্তুক। তিনি রাজনৈতিক কর্মী ও পোল্যান্ডের ডানপন্থী সরকারের সমালোচক। তোকার্তুক এমন একজন আখ্যানকার, যিনি কল্পনা দিয়েই দেশ-কালের সীমা ভেঙে দিয়েছেন। তার ভাষা বাহুল্যবর্জিত ও কাব্যিক। পোল্যান্ডের নাইক পুরস্কার লাভের পর এক টেলিভিশন সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন, নিপীড়নকারীদের হাত থেকে মানুষকে রক্ষায় দেশপ্রেমিকরা বিভিন্ন সময় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। এটা যেন একটি ইতিহাস। তার সাহিত্যকর্মের মধ্যে ফ্লাইটস, দ্য বুক অব জ্যাকব, ড্রাইভ ইওর প্লো ওভার দ্য বোনস অব দ্য ড্যাড, প্রাইমিভল অ্যান্ড আদার টাইমস, লালকা আই পেরলা ও ডার্ক রুমস উল্লেখযোগ্য।

২০১৯ সালের সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন অস্ট্রিয়ার অনুবাদক, নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক পিটার হ্যান্ডকে। মানুষের অভিজ্ঞতার পরিধি ও সুনির্দিষ্ট চেহারা অসামান্য ভাষাগত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে পারেন তিনি। ১৯৪২ সালের ৬ ডিসেম্বর অস্ট্রিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর প্রিফেনে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৬৫ সালে মাঝপথে লেখাপড়া ছেড়ে দেন। যোগ দেন আভাগার্দ আন্দোলনে। শুরু হয় ছবির চিত্রনাট্য লেখা। ১৯৭৮ সালে তার নির্দেশনায় তৈরি ছবিদ্য লেফট হ্যান্ডেড উইম্যান সে বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে মনোনীত হয়। যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধের সমালোচনা করে তার লেখা সারা পৃথিবীতে ঝড় তোলে। যুদ্ধের কারণ ও ফল বিষয়ে বারবার পশ্চিমা দুনিয়ার সমালোচনা করে এসেছেন পিটার। বিতর্ক তার চিরসঙ্গী হয়ে থাকছে। ভাষাগত দক্ষতার সঙ্গে মানবিক অভিজ্ঞতার পরিধি ও বৈশিষ্ট্যের সন্ধান করেছেন এমন কিছু উল্লেখযোগ্য কাজের জন্য তাকে এ বছরের নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তবে তিনি মূলত পুরুষকেন্দ্রিক লেখায় অভ্যস্ত। এজন্য অনেক মহলে তার লেখা বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে। নোবেল কমিটিও প্রাথমিক পর্যায়ে এমন একটি মনোভাব পোষণ করলেও তাকেই চলতি বছরের নোবেল পুরস্কার দিল। শিল্পের বিভিন্ন শাখায় পারদর্শী পিটার নব্বইয়ের দশক থেকে প্যারিসে বসবাস করছেন। তারউই নিউ নাথিং অব ইচ আদারউইম উইন্ডারস উইনস অব ডিজায়ার দুটি উল্লেখযোগ্য নাট্যকর্ম। ২০০৬ সালে সার্বিয়ান যুদ্ধাপরাধীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় একটি বক্তব্য রেখেছিলেন, যার জন্য তিনি বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন। একই বছর হেইরিচ হেইন প্রাইজের জন্য তার নাম মনোনয়নে  থাকলেও রাজনৈতিক কারণে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ২০১৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইবসন অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হলেও তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। তর্ক-বিতর্ক ও বিদ্বেষ ছাপিয়ে তিনি তার লেখা চালিয়ে গেছেন এবং নিজের জোরালো অবস্থানের কাছে আত্মবিশ্বাসের সুদৃঢ় ভিত রচনা করেছেন। বর্তমান যুগের সাহিত্যিক কিংবা যেকোনো পেশার মানুষের কাছে এটি একটি বিরাট শিক্ষা। মানুষের সমালোচনা থাকবেই। তার পরও তাকে এগিয়ে যেতে হয়। সমালোচনা তার চিরসঙ্গী কিন্তু সেই সমালোচনা তাকে সাহিত্য সাধনা থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারেনি। আর তারই স্বীকৃতি তিনি পেলেন নোবেলের মতো আন্তর্জাতিক সম্মানজনক পুরস্কার।

পিটার হান্ডকেকে মনে করা হয় জার্মান ভাষার সবচেয়ে চিন্তাজাগানিয়া লেখক। ষাটের দশকে তিনি সাহিত্যের জগতে পদার্পণ করেন। রয়্যাল সুইডিশ একাডেমির বিচারকরা বলছেন, সমসাময়িক উপন্যাসের জগতে কয়েক দশক ধরেই তিনি অন্যতম প্রভাবশালী লেখক। ১৯৭১ সালে তার মায়ের আত্মহত্যা নিয়ে ১৯৭৫ সালে প্রকাশিতআ সরো বিয়ন্ড ড্রিমস হান্ডকের সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থ। একাডেমির সদস্যরা বলেন, তারা হান্ডকের ২০১৭ সালেরডিয়ে অবসডিয়েবিন পড়ে মুগ্ধ হন। এতে তিনি অজানা স্থানকে তুলে ধরেছেন। তারদ্য গোলকিপারস ফিয়ার অব দ্য পেনাল্টি উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৭২ সালে জার্মান পরিচালক ভিম ভেন্ডার্সের একাধিক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেছেন। ছবি পরিচালনা করেছেন নিজেও। সাহিত্যকর্মে তার ভাষার কুশলতায় তিনি মানুষের অভিজ্ঞতার সীমানা ও নির্দিষ্টতা ছুঁয়ে গেছেন, যা নোবেল কমিটির দৃষ্টি এড়ায়নি।

 

মাছুম বিল্লাহ: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত

ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেল্টা)

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন