পদ্মা ও আটলান্টিকতীরে রবীন্দ্রসংগীত

জাহিদ হায়দার

নদীটা যেন একটা সুবৃহৎ প্রাণ পদার্থের মতোএকটা প্রবল উদ্যম রাশি বহুদূর হতে গর্বভরে কলস্বরে অবহেলে চলে আসছে। তাই দেখে আমাদের প্রাণের মধ্যে একটা আত্মীয়তার স্পন্দন অনুভূত হতে থাকে।...আমি অনেকবার ভেবে দেখেছিপ্রকৃতির মধ্যে যে এমন একটা গূঢ় গভীর আনন্দ পাওয়া যায়, সে কেবল তার সঙ্গে আমাদের একটা সুবৃহৎ আত্মীয়তার সাদৃশ্য অনুভব করেএই নিত্যসঞ্জীবিত সবুজ তৃণলতা-তরুগুল্ম, এই জলধারা, এই বায়ুপ্রবাহ, এই সতত ছায়ালোকের আবর্তন, এই ঋতুচক্র, এই অনন্ত-আকাশ-পূর্ণ জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর প্রবাহমাণ স্রোত, পৃথিবীর অনন্ত প্রাণীপর্যায়, এই সমস্তের সঙ্গেই আমাদের নাড়ীর রক্ত চলাচলের যোগ রয়েছে—‘সমস্ত বিশ্বচরাচরের সঙ্গে আমরা একই ছন্দে বসানোএই ছন্দের যেখানে যতি পড়ছে, যেখানে ঝংকার উঠছে, সেখানেই আমাদের মনের ভেতর থেকে সায় পাওয়া যাচ্ছেপ্রকৃতির সমস্ত অণু-পরমাণু যদি আমাদের সগাত্রে না হতো, যদি প্রাণে সৌন্দর্যে এবং নিগূঢ় একটা আনন্দে অনন্তকাল স্পন্দমান থাকত, তাহলে কখনই এই বাহ্য জগতের সংসর্গে আমাদের এমন একটা আন্তরিক আনন্দ ঘটত না।’ (ছিন্নপত্র, পত্রসংখ্যা : ২২৭। ..১৩০২। ১৩ অগস্ট, ১৮৯৫; শিলাইদহ)

সব স্থানে সংগীত বিরাজ করে, কেউ শুনতে পায়, কেউ পায় না। সবারই শ্রবণশক্তি আছে, কিন্তু সব শ্রবণই শ্রেয় ধ্বনির প্রতি আগ্রহী নয়। অবশ্য সব গানই যে শ্রেয়বোধে ঋদ্ধ হবে, তার নির্দিষ্ট হিসাবরেখা নেই।

সব প্রাণের, সব বস্তুর আছে নিজস্ব গান। প্রাণ না হয় জীবনসঞ্চারী একটি জিনিস, তার মধ্যে যে চলমানতার ধ্বনি আছে, তাকে অর্থাৎ ওই ধ্বনিকে গান হিসেবে ধরলে আপত্তি ওঠে না, বরং সংবেদী হূদয় ওই ধ্বনির কাছ থেকে এক সুখকর আশ্রয় পায়। কিন্তু বস্তুর আবার নিজস্ব গান কিসের? প্রশ্ন উঠতে পারে। একটি সবুজ মাঠের বিস্তারের মধ্যে বড় একটি সাদা পাথর, এই পাথরকে রাত্রি কিংবা দিবাভাগের যে সময়ই দেখা যাক না কেন, তার অস্তিত্ব অসহিংস অহংকার ঘোষণা করছে নীরবে এবং দর্শকের চোখ মনকে বলছে, আমার অবস্থান তোমার বোধে যে বাণী সৃষ্টি করল, তা- আমার গান। বস্তুর নিজস্ব রূপকে মানুষ তার আকাঙ্ক্ষিত রূপে গ্রহণ করতে চায়। সেজন্য মানুষ কঠিন খসখসে পাথর কেটে বের করে প্রিয় চোখ বা মুখ বা শরীর-সৌন্দর্যের শিল্প। ভাস্কররা বাটালির তীক্ষ ধারে কঠিন বস্তুকে কেটে নয়ন মানস তৃপ্তকর আকার দিয়ে নিজেই নিজেকে বলে, নির্মিত হলো আমার শিল্প, আমার গান।

রঙপাত্রে রাখা রঙ চিত্রকলা নয়, ওই রঙ পরিমিত মূর্ত-বিমূর্ত বিন্যাসে শিল্পীর হাতে যখন রূপ পায়, তখন হয়ে ওঠে চিত্রকলা। কাঠ, পাথর, ধ্বনি, রঙ বা শব্দ ইত্যাদি যার হাতেই পড়ুক সে ব্যক্তি যদি সঠিক মাত্রা ওইসব বিষয়কে না দিতে পারে, তাহলে ওইগুলো থেকে শিল্পমানসম্পন্ন গান সৃষ্টি হয় না, শিল্প হয় না, কবিতা হয় না। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে আমাদের চারদিকে পরিমার্জনহীন অবস্থায় যা কিছু বিরাজ করছে, তার মধ্যে কি কোনো গান নেই? অবশ্যই তার মধ্যে গান আছে। ওই গান, প্রথমেই বলেছি, সবাই শোনে না। প্রকৃতি থেকে জাত সব বস্তুই নিজস্ব শিল্পসম্মত মাত্রা ধারণ করে আছে। সেই মাত্রা পূর্ণতার সকল অংশকে নিজেই ধারণ করে

");

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন