স্কেলআপ: ব্যবসা বড় করার সোপান

শওকত হোসেন

স্মল ইজ বিউটিফুল। বাট ফর বাংলাদেশ, বিগ ইজ নেসেসারি। বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য উদ্যোক্তার উক্তি এটি। অবশ্য তার বিচরণ মূলত উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে। কিছু সামাজিক ব্যবসায়ও যুক্ত আছেন। তাই নেসেসারি শব্দ চয়ন। স্রেফ ব্যবসায়ীর চোখে দেখলেও ব্যবসা বড় করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে লাভ বাড়ে। ইকোনমিকস অব স্কেল মেলে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আলাদা একটা হিসাব আছে। এখানে ব্যবসা ছোট রাখাটা অপচয়। সুযোগের, শ্রমের, অর্থের। ডেনসিটি  ডিভিডেন্ড বা ঘনত্ব লভ্যাংশ বলে একটা শব্দবন্ধ বাংলাদেশের জন্য প্রায়ই উচ্চারিত হয়। বাংলাদেশের জনঘনত্ব বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ১০৫ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘনত্ব ভারতে, ৪১৬ জন, আমাদের ঘনত্বের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। জনঘনত্বের অনেক অসুবিধা আছে। আছে কিছু সুবিধাও। অল্প খরচে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অনেক গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। তাই এ দেশে ব্যবসা বড় করা লাভজনক।

কিন্তু সব স্টার্টআপ বড় হবে বা হতে পারবে তা নয়। অনেক উদ্যোক্তার সীমাবদ্ধতা আছে। তারা ছোট প্রতিষ্ঠান চালাতে পারেন। বড় করতে গেলেই ফেল মারেন। ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে তাই কিছু ব্যাপার নজরে রাখা উচিত:

১. প্রডাক্ট মার্কেট ফিট: অনেক উদ্যোক্তা প্রডাক্ট মার্কেট ফিট বা তার পণ্যের বাজারে গ্রহণযোগ্যতা আছে কিনা, যাচাই করার আগেই স্কেলআপ বা ব্যবসা সম্প্রসারণ শুরু করেন। ছোট পরিসরে পণ্যের বাজারে গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করে নেয়া উচিত। বড় আকারে গেলে যেকোনো পরিবর্তনই ব্যাপক ব্যয়বহুল। তাছাড়া ব্যবসা বড় করার পেছনে বড় যুক্তি বা কারণ হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানের উপাদিত বা সরবরাহকৃত পণ্য বা সেবাটির বাজারে ব্যাপক চাহিদা আছে। তাই আরো পণ্য বা সেবা গ্রাহককে দিতে হবে বা দেয়ার সুযোগ আছে। সেজন্য প্রয়োজন প্রতিষ্ঠান বড় করা। পণ্য মানে শুধু পণ্য নয়; কটলারের মতবাদ অনুসারে, এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত মূল্য, স্থান ও প্রচারণা। আমার এক বন্ধু বিদেশ থেকে মানসম্পন্ন খাদ্যসামগ্রী আমদানি করে সুপারস্টোরের মাধ্যমে বিক্রি করেন। একবার তিনি একটা নতুন পণ্য আমদানি করে তার প্রতিযোগীদের তুলনায় ২০ শতাংশ ছাড়ে সুপারস্টোরে  দিলেন। ভাবলেন দাম কম হওয়ায় হু হু করে পণ্যটি বিক্রি হয়ে যাবে। হা হতোস্মি। মেয়াদ ঘনিয়ে আসায় একটা বিরাট অংশ তাকে সুপারস্টোর থেকে তুলে নিতে হলো। অনেক লোকসান গুনতে হলো। পরে একই পণ্য আবার আমদানি করলেন। কোনো ছাড় ব্যতিরেকে সুপারস্টোরে দিলেন। এবার ঠিকই হু-হু করে বিক্রি হয়ে গেল। অর্থা প্রথমবার পণ্যের মূল্য সঠিক ছিল না। দামি পারফিউম নিশ্চয়ই গলির মুুদিদোকানের মাধ্যমে বিক্রি হবে না। কোনো অভিজাত দোকান তার উপযুক্ত স্থান। পাড়ার সেলুনের বিজ্ঞাপন কি জাতীয় পত্রিকায় দেয়া ঠিক হবে? পণ্যের এসব সমস্যার সমাধান বের না করে স্কেলআপ করা উচিত নয়। এসবের সমাধান খুঁজে পেতে বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হয়। একসময় উদ্যোক্তা বুঝতে পারেন সবচেয়ে ভালো বিকল্প কোনটি।

২. সঠিক লোক সঠিক স্থানে: স্টার্টআপ অল্প কয়েকজন লোক দিয়ে চলে। একই লোক বিভিন্ন কাজ করে। সম্পর্ক অনেক অনানুষ্ঠানিক থাকে। স্কেলআপ বা সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ লোকের প্রয়োজন হয়। প্রতিষ্ঠান যখন ছোট থাকে, তখন অনেকে উর্গিতভাবে কাজ করেন। কিন্তু ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য যে ধরনের দক্ষতা দরকার, তা হয়তো থাকে না।


সেক্ষেত্রে বাইরে থেকে নতুন লোক নিয়োগ দিতে হয়, বেশি বেতনে বড় পদমর্যাদায়। নিবেদিত কর্মীদের জন্য তা মনঃপীড়ার কারণ হতে পারে। পুরনো কর্মীর মনরক্ষার্থে অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দক্ষ লোক নিয়োগ দেয়া হয় না, যা দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। পুরনো লোকদের তাদের জ্ঞান, দক্ষতা ও আগ্রহ অনুসারে পদায়ন করা উচিত। তাতে কেউ মনঃক্ষুণ্ন হলেও এখানে আবেগের কোনো অবকাশ নেই।

৩. প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি বা অর্গানাইজেশন কালচার: প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একটি সংস্কৃতি বা কালচার আছে। প্রতিটি স্টার্টআপেরও একটা কালচার তৈরি হয়। প্রতিষ্ঠান ছোট হওয়ায় উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের কালচার গড়তে, বদলাতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। প্রতিষ্ঠান বড় হলে বাইরের অনেক লোক প্রবেশ করে। কালচার সম্পর্কে তেমন ওয়াকিবহাল থাকেন না। তাছাড়া তার আগের প্রতিষ্ঠানের কালচার মগজে নিয়ে আসেন। তাতে কালচারাল দূষণ আরো হয়। প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হাসিলে কালচারের ভূমিকা ব্যাপক। কালচার জোরদার করার জন্য সহজবোধ্যভাবে কিছু মূল্যবোধ সাজাতে হবে, যা কর্মীদের সুস্পষ্টভাবে জানাতে হবে। বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে। ভালোভাবে পরিপালনের জন্য পুরস্কৃত করতে হবে। কেউ জেনে-শুনে অমান্য করলে শাস্তি দিতে হবে।

৪. কাঠামো বা স্ট্রাকচার: স্টার্টআপ পর্যায়ে উদ্যোক্তা প্রায় সব কাজ তদারক করেন। স্কেলআপের জন্য কাজের বিশেষায়ণ প্রয়োজন। স্টার্টআপ ফ্ল্যাট কাঠামোয় চালাতে পারে। নতুন কর্মী নিয়োগের পর কাঠামো দাঁড় করাতে হয়। নতুবা বেশি বেতন দেয়া সত্ত্বেও নতুন নিয়োজিত কর্মীর কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না। স্টার্টআপে সবাই উদ্যোক্তার কাছে রিপোর্ট করে, যেটা প্রতিষ্ঠান বড় হলে আর সম্ভব হয় না। উদ্যোক্তা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেন। তিনি যাদের তত্ত্বাবধান করেন, তারা আবার বিভিন্ন টিমকে তত্ত্বাবধান করেন। সেই তত্ত্বাবধায়কদের ক্ষমতায়ন করা প্রয়োজন। কাজের স্বাধীনতা দেয়া প্রয়োজন। অনেক মালিক কর্মীদের স্বাধীনতা দিতে ভয় পান। ভাবেন যদি চুরি করে অথবা নয়ছয় করে! কিন্তু স্বাধীনতা না পেলে দক্ষ কর্মী প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে আসবেন না বা এলেও থাকবেন না। তাছাড়া স্বাধীনতা না দিলে একজন কর্মীর প্রতিভার পূর্ণ সদ্ব্যবহার হয় না। তার কাছ থেকে তার দক্ষতা অনুযায়ী ফল পাওয়া যায় না। তাদের কাছে চাহিদা কী, বুঝিয়ে দিতে হবে। নির্দিষ্ট সময় শেষে ফল যাচাই করতে হবে। ফলাফল মনিটর করার জন্য কেপিআই বা দক্ষতা পরিমাপের মাপকাঠি নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

৫. মূল্যহ্রাসের ফাঁদে পা না দেয়া: স্কেলআপ মানে প্রতিষ্ঠান বড় হবে। লোকবল বাড়বে। বিক্রি বাড়বে। অনেক উদ্যোক্তা মূল্য হ্রাস করে বিক্রি বাড়ানোর চিন্তা বা চেষ্টা করেন। এটি আত্মঘাতী হতে পারে। মূল্য হ্রাস করলে পণ্যের কিছু ফিচার বাদ অথবা সেবার মান কমানো হতে পারে, যা চাহিদা বা ক্রেতাসন্তুষ্টি কমিয়ে দেবে। উদ্যোক্তাকে বিক্রয় বাড়ানোর জন্য আবার মূল্য হ্রাস করতে হতে পারে। এ দুষ্টচক্রে পড়ে কম্পিটিটিভ অ্যাডভান্টেজ বা ভিড়ের মাঝে আলাদা হওয়ার সুযোগ হারাতে হবে। 

৬. দীর্ঘমেয়াদি চাহিদা সৃষ্টি: উদ্যোক্তাকে বিক্রয় ও বিপণন নিয়ে এত ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয় যে নতুন বাজার বা দীর্ঘমেয়াদি বাজার সৃষ্টিতে মনোযোগ দিতে পারেন না। অথচ প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার জন্য দীর্ঘমেয়াদি বাজার সৃষ্টি অতীব জরুরি। এসব ক্ষেত্রে তাত্ক্ষণিকভাবে সুবিধা পাওয়া যায় না অথচ খরচ এখনই করতে হয় বলে মুনাফায় আঘাত আসে।

৭. মেদ কমানো: সম্প্রসারণের  ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা খরচ বাড়ানোর কথাই ভাবেন শুধু। লোকবল বাড়াতে হয়। ভৌত কাঠামো বাড়াতে হয়, দৈনন্দিন খরচ বাড়ে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অঙ্গে নানা অদক্ষতাও বেড়ে ওঠে অথবা লুকিয়ে থাকার সুযোগ পায়। উদ্যোক্তাকে এ অদক্ষতা চিহ্নিত করে তা উপাটনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিষ্ঠান বড় হলে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের সুযোগ আসে। যেমন ছোট অবস্থায় হয়তো একজন হিসাবরক্ষকের পুরোপুরি কাজ থাকে না। আবার গোপনীয়তা রক্ষার জন্য খণ্ডকালীন কোনো হিসাবরক্ষক রাখাও উদ্যোক্তার পছন্দ নয়। প্রতিষ্ঠান বড় হলে হিসাবরক্ষকের পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারের সুযোগ মেলে।

৮. পথ চলতি আকস্মিক সমস্যাকে পাস না কাটানো: সম্প্রসারণকালে উদ্যোক্তা কৌশলগত ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। অনেক সমস্যা সামনে এসে দাঁড়ায়, যা আগে কল্পনা করা হয়নি। এর মধ্যে কিছু আকস্মিক সমস্যার উদ্ভব ঘটতে পারে। অনেক উদ্যোক্তা এসব ক্ষেত্রে আরে রাখো বলে দূরে সরিয়ে দেন বা পরে দেখা যাবে বলে পাস কাটিয়ে যান। সময়মতো সমাধান না করায় মামুলি সমস্যাও পরবর্তী সময়ে বৃহ আকার ধারণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে সম্প্রসারণ দূরে থাক, ব্যবসার দৈনন্দিন কার্যক্রমই ব্যাহত হয়। তাই উদ্ভূত সমস্যাকে খাটো করে দেখা উচিত নয়।

৯. অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ: কর্মীদের স্বাধীনতা দিতে হবে। কিন্তু সেই স্বাধীনতার যাতে অপব্যবহার না হয়, তার জন্য অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী ও স্বাধীন করতে হবে। বিভিন্ন নীতিমালা, গাইডলাইন লিখিত থাকতে হবে। অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ থাকতে হবে, যা নির্দিষ্ট সময় অন্তর হিসাবের বই ও কার্যক্রম নিরীক্ষা করবে। অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষাকে হিসাব বিভাগ থেকে আলাদা হতে হবে এবং প্রধান নির্বাহী বা পরিচালনা পর্ষদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। নিরীক্ষা বিভাগের সুপারিশ অনুযায়ী তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

শওকত হোসেন: ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিশেষজ্ঞ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন