[পূর্ব প্রকাশের পর]
গণিত ভাবনা পর্ব ৯: ঠাঁই নাই,
ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী
এবারের পর্বে
যাকে নিয়ে লিখব, তার নাম মুহাম্মদ ইবনে মূসা আল
খারিজমি। সংক্ষেপে আল খারিজমি। আল খারিজমির জন্ম ৭৮০ খ্রি.
এবং মৃত্যু ৮৫০ খ্রি.। জন্মস্থান
বর্তমান উজবেকিস্তানের খারিজমে, যা থেকে তার
খারিজমি নাম। যে সময়কালকে বলা হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের
ক্ষেত্রে মুসলিম স্বর্ণযুগ, সে সময়কালের
শ্রেষ্ঠতম একজন তিনি। অথচ তার কাছাকাছি সময়কার অনেকেই যেমন ওমর খৈয়াম,
ইবনে সিনা ও শেখ সাদি ঘরে ঘরে মোটামুটিভাবে পরিচিত নাম। তারা কী করেছেন
তা না জানা থাকলেও নামটা ঠিকই জানা আছে। আর আল খারিজমি যা করেছেন,
তা জানা থাকলেও নামটা অজানা। কিছুদিন আগে কবি কামরুল হাসান উজবেকিস্তান
নিয়ে একটা চমত্কার ভ্রমণ কাহিনী লিখেছিলেন। নাম ‘আমির তিমুরের
দেশে’। আমি পাঠকদের বলব বইটা পড়ে দেখতে। উজবেকিস্তান সম্পর্কে অনেক কিছুই
জানতে পারবেন সেখানে। তবে আল খারিজমি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু লিখলে কামরুল হাসান
ভাই ভালো করতেন। এছাড়া বাদ পড়ে গেছেন আরো অনেকেই। বিশেষ করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সেই
স্বর্ণযুগের সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্মস্থানই যেখানে বর্তমান উজবেকিস্তান।
আল খারিজমিকে নিয়ে লিখতে গিয়ে কেন শিরোনামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
‘সোনার তরী’ থেকে পঙিক্ত ধার করলাম,
তার ব্যাখ্যা এখন দিচ্ছি। সোনার তরী কবিতাটির কাহিনী মোটামুটি হলো,
কবি একটা দ্বীপের মতো জায়গায় তার ফসল কাটছেন। সেই ফসল তিনি তুলে
দিচ্ছেন সোনার এক তরীতে। সে তরী ফসলে এমন ভরে উঠেছে যে,
নৌকায় কবির ঠাঁই হয় না। সোনার তরী চলে যায় দূরের এক মসীমাখা গ্রামে।
কবি পড়ে থাকেন নদীতীরে একা। কবিতার ব্যাখ্যা হয়তো এ রকম যে,
মহাকাল কর্ম নিয়ে চলে যায়, কিন্তু
ব্যক্তির তাতে স্থান হয় না।
কিন্তু ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী’র সঙ্গে আমি
জীবনের আরেকটি বাস্তবতার মিল খুঁজে পাই। তা হলো কিছু মানুষের কর্মের পরিমাণ ও
গুণগত মান এত বিস্ময়কর যে, কীভাবে তা
মানুষের বেঁচে থাকার সময়কালের মধ্যে সম্ভব, আমি বুঝে উঠতে
পারি না। মানুষ বেঁচে থাকে গড়ে মাত্র ৫০ থেকে ৯০ বছর পর্যন্ত। এর মধ্যে কাজ করার
সময় আরো কম। ২০ থেকে শুরু করে ৬০ বছরের মধ্যেই সংসার,
সন্তান, চাকরি, আয়-রোজগার সবই
সেরে ফেলতে হয়। সৃজনশীল কোনো কাজ করার শ্রেষ্ঠ সময়টা তখনই। আরো বলতে গেলে
সৃজনশীলতার শ্রেষ্ঠ সময় শেষ হয়ে যায় চল্লিশ-পঞ্চাশের
মধ্যেই। সংসার সমরাঙ্গনে দৃঢ়পণে যুদ্ধের পাশাপাশি তাই করে যেতে হয় অন্য সৃষ্টিশীল
কাজগুলো।
রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাদের একজন, যদিও জীবিকার
জন্য তাকে সেভাবে কাজ করতে হয়নি। তবুও তার জীবনও সোনার তরী কবিতার নৌকাটার মতো,
যেন তাতে আর তিল ধারণের জায়গা নেই। কবিতা,
গান, গল্প, উপন্যাস এমন
কোনো কিছু নেই, যা তিনি করেননি। রবীন্দ্রনাথ নির্মাণ
করে দিয়েছেন বাংলা ভাষাকে। আমরা যেভাবে কথা বলি, চিন্তা করি,
তা অনেকভাবেই রবীন্দ্রনাথ থেকে পাওয়া।
গণিতের জগতেও আছে এ রকম বিস্ময়কর কিছু ব্যক্তিত্ব,
যাদের জীবনও সেই ঠাঁই না হওয়ার নৌকার সঙ্গে তুলনীয়। তাদের কর্মের
পরিমাণ ও গুণগত মান রীতিমতো অতিমানবীয়। কীভাবে এক জীবনে তা সম্ভব তা আমি বুঝে উঠতে
পারি না। আল খারিজমি তাদেরই একজন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার মিল হলো যে তিনিও
নির্মাণ করে গেছেন গণিতের ভাষা।
আমরা সবাই বীজগণিত বা অ্যালজেব্রার সঙ্গে পরিচিত। আল খারিজমি হলেন
বীজগণিতের জনক। তার রচিত গ্রন্থ ‘কিতাব আল জাবর
ওয়াল মুকাবলা’র লাতিন অনুবাদ থেকে এসেছে
অ্যালজেব্রা শব্দটি। অ্যালজেব্রায় ১, ২,
৩, ৪ ইত্যাদি করে সংখ্যাকে প্রকাশের
পাশাপাশি y, z ইত্যাদি
প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এভাবে অ্যালজেব্রা কষার সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত।
একটি উদাহরণ দেয়া যাক। পিতার বয়স পুত্রের বয়সের চার গুণ অপেক্ষা ৪
বেশি। মাতার বয়স পুত্রের বয়সে তিন গুণ অপেক্ষা ১০ বেশি। পিতার বয়স মাতার বয়সের
থেকে ১ বেশি। পিতা, মাতা ও পুত্রের বয়স কত?
বীজগণিতের সাহায্যে খুব সহজেই অংকটা করা যাবে।
পুত্রের বয়স আমাদের অজানা। আসুন মনে করি বয়সটি
হলো x।
তাহলে পিতার বয়স ৪x+৪ ও মাতার বয়স
৩x+১০।
পিতার বয়স মাতা থেকে ১ বেশি।
আমরা লিখতে পারি:
পিতার বয়স = মাতার বয়স+১,
অর্থাৎ ৪x+৪ = ৩x+১০+১,
অর্থাৎ ৪x-৩x =
১১-৪, অর্থাৎ
x
= ৭
অতএব পিতার বয়স ২৮+৪ = ৩২ ও মাতার বয়স ৩১ বছর।
উপরের উদাহরণ দেখায় যে বীজগণিতের সাহায্য অংক কষা সহজ। পাটিগণিতের
সাহায্যেও অংকটা করা যাবে, তবে করতে অনেক
সময় লেগে যাবে আমি নিশ্চিত।
উপরের অংক কষার জন্য আমরা আগে অজানা একটা
সংখ্যা x ধরে নিয়েছি। আল খারিজমি এ পদ্ধতিতে অংক করার উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে
গেছেন। এভাবে অংক কষার পদ্ধতি অর্থাৎ বীজগণিত উদ্ভাবনের মাধ্যমে আল খারিজমি একাই
গণিতশাস্ত্রকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছেন। বীজগণিত ছাড়া এখন গণিতশাস্ত্র অচল।
দশমিক পদ্ধতিতে গণনার সঙ্গেও আমরা সবাই পরিচিত। দশমিক পদ্ধতিতে শূন্য
থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যাকে ০, ১,
২, ৩, ৪,
৫, ৬, ৭,
৮ ও ৯ চিহ্নের মাধ্যমে লেখা হয়। ১০ লিখতে হলে ১-এর পরে একটা শূন্য
বসানো হয়। শূন্যের জন্য আলাদা একটা প্রতীকের প্রথম ব্যবহার করেন ভারতীয় গণিতবিদ
ব্রহ্ম গুপ্ত, ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। আল খারিজমি
সেই শূন্য ব্যবহার করে উদ্ভাবন করেন দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি,
যা এখন সবাই ব্যবহার করছে। এ সংখ্যা পদ্ধতিকে তাই বলা হয় হিন্দু-আরবীয় সংখ্যা
পদ্ধতি। তুলনায় রোমান সংখ্যা পদ্ধতিতে ১ থেকে ১০ হলো
i,
ii,
iii, iv,
v, vi, vii,
viii,
ix,
x । লক্ষ করুন, রোমান সংখ্যায়
শূন্যের জন্য আলাদা কোনো চিহ্ন নেই।
বীজগণিত ও দশমিক পদ্ধতিতে গণনা—আল খারিজমির এ
দুই অবদান আমাদের জীবনকে যে সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছে, তাতে কোনো
দ্বিমত থাকার কথা নয়। গণিত যে ভাষার কথা বলে, তা তাই আল
খারিজমির তৈরি ভাষা। আল খারিজমিকে না জানলেও তিনি যা শিখিয়েছেন তা আমরা প্রতিনিয়ত
ব্যবহার করছি।
এ মহান গণিতবিদের আরো নানা ধরনের অবদান আছে। তবে আরেকটির কথা না বললেই
নয়। তা হলো বর্তমানে বহুল ব্যবহূত অ্যালগরিদম শব্দটি এসেছে আল খারিজমির নামের
লাতিন ভাষান্তর ‘আলগরিদমি’ থেকে।
অ্যালগরিদম বলতে বোঝায় ফলাফল পাওয়ার জন্য যে প্রক্রিয়া ব্যবহার করতে হবে তা। এতে
প্রক্রিয়াটি কেন কাজ করে তা না বুঝলেও চলবে। যেমন আমরা ছোটবেলায় ভাগ করার
প্রক্রিয়া শিখতাম। আজকাল অ্যালগরিদম শব্দটি কম্পিউটার-বিষয়ক কাজে
ব্যবহার করা হয় কোনো কিছু করার প্রক্রিয়া বোঝানোর জন্য। আমরা ছোটবেলায়
মোটরসাইকেলকে হোন্ডা বলতাম। বিদেশে এসে দেখেছি অনেকে ফটোকপি করাকে জেরক্স,
ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করাকে হুভার করা বলে। সে রকমভাবেই আমার মনে
হয় আল খারিজমির পদ্ধতিতে গণিত করতে করতে আল খারিজমি বা অ্যালগরিদমি বলা শুরু হয়ে
গিয়েছিল।
পাদটীকার মতো আল খারিজমিকে নিয়ে আরেকটি শেষ কথা। বোর্নমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে
আমার এক সহকর্মী জাতিতে উজবেক। মুসলিম স্বর্ণযুগে উজবেকিস্তানে জন্ম নেয়া মনীষীদের
মধ্যে তার সবচেয়ে গর্ব আল খারিজমিকে নিয়ে। তার কাছে শোনা আল খারিজমি যে শহরে জন্ম
নিয়েছিলেন, সেখানকার সবাই নাকি অংক কষায় দক্ষ।
কথাটা কি সত্য না মিথ্যা, তা যাচাই করার
সুযোগ এখনো হয়ে ওঠেনি।
মেহেদী মাহমুদ চৌধুরী: যুক্তরাজ্যের বোর্নমাউথ ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির
শিক্ষক