মুসলিম ইমারত শৈলীর বাঙালি রীতি

আহমদ হাসান দানী

অতীতে বাঙালি মুসলিম স্থাপত্য নিয়ে খুব অপর্যাপ্তভাবে গবেষণা হয়েছে। ফার্গুসন ভারতীয় মুসলিম স্থাপত্যের শ্রেণীকরণে ১৩টি রীতির মধ্যে একটি হিসেবে বাঙালি রীতিকে স্থান দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি গৌড় ও পান্ডুয়ার কেবল গুটিকয়েক ইমারত নিয়ে কাজ করেছিলেন। হাভেল কেবল ভারতীয় ইসলামী স্থাপত্যে তার ‘ইন্ডিয়াননেস’ তত্ত্ব প্রমাণের জন্য এসব ইমারত বিবেচনায় নিয়েছিলেন। মার্শাল তার গ্রন্থে বাংলা এবং প্রাক-মোগল ইমারতগুলো বিশ্লেষণ বিষয়ে একটি অধ্যায় সংযোজন করেছিলেন। পার্সি ব্রাউন তাদের পথ অনুসরণ করেছিলেন এবং বাংলারীতিকে অন্যতম আঞ্চলিক স্থাপত্যশৈলী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তবে তিনি খ্রিস্টীয় ১৩০০ ও ১৫০০ শতকের কাছাকাছি নির্মিত ইমারতগুলো নিয়ে কাজ করেছিলেন। উল্লিখিত সবার গবেষণাকর্মে পদ্ধতি ছিল দিল্লি ও আগ্রার কেন্দ্রীয় বা সাম্রাজ্যিক শৈলীকে প্রাধিকার দেয়া; বিপরীতে আঞ্চলিক ইমারতগুলোকে কেবল ভারতীয় ইসলামী স্থাপত্যে বৈচিত্র্য সরবরাহ হিসেবে দেখা। কিন্তু একটি কথা মনে রাখতে হবে, সর্বভারতীয় সংস্কৃতির কিছু সাধারণ বন্ধন থাকলেও আঞ্চলিক ঐতিহ্যগুলো স্থানীয় ইতিহাস ও ভূগোলে গভীরভাবে শেকড়বদ্ধ এবং সেগুলো দীর্ঘ সঞ্চিত অভিজ্ঞতার উত্তরাধিকার। এসব ঐতিহ্য নিজেই স্বতন্ত্র রূপ-আকার গঠন করে এবং সেগুলো জীবনের সাধারণ সমস্যার মুখোমুখি হওয়া জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। এসব মিলে বৃহত্তর সমগ্রতা তৈরি হলেও স্বাতন্ত্র্যিকতা কখনো বিসর্জিত হয়নি। এটিই বৃহত্তর ও সুখী সাংস্কৃতিক পরিসরের বাস্তবায়ন, যেটি আঞ্চলিক সত্তা বা ইউনিটগুলোকে মানব কর্মকাণ্ডের একটি সাধারণ বন্ধনে বাঁধে। ওপর থেকে যখন দেখি তখন আমরা মানুষের লড়াই-উদ্যমটা কমই পাই, প্রবল বৃষ্টিপাত ও সংঘাতে ভরা প্রাচুর্যপূর্ণ জঙ্গলের বিপরীতে যারা মানব স্থাপনা সৃষ্টিতে চেষ্টা করে গেছেন। যদি স্থাপত্য ইটে মানুষের ইচ্ছার প্রকাশ হয় এবং মসলায় (মর্টার) শ্রেষ্ঠ কিছু সৃষ্টি প্রকৃতির ক্যানভাসে নিজের স্বাতন্ত্র্যিক প্রতিভা প্রকাশের কিছু হয়, যা তাকে প্রকৃতির কোলের সঙ্গে একীভূত করতে প্রস্তুত; তাহলে স্থানীয় অবস্থার চাহিদার বিপরীতে স্থাপত্যিক ধরন গবেষণা ও শৈলী মূল্যায়িত হওয়া আবশ্যক। মানুষের উদ্দেশ্য কেবল তখনই বোঝা যায়, যখন সুনির্দিষ্ট পারিপার্শ্বিকতায় সে প্রশংসিত হয়, যেখানে সে অবস্থান করে। ইমারতগুলো কোনো চূড়ান্ত পণ্য নয়, সেগুলো সৃষ্টি করা হয় জীবনের সুনির্দিষ্ট শর্ত বা অবস্থা পূরণের জন্য। আমাদের প্রচেষ্টা হবে সুনির্দিষ্ট অবস্থাগুলো দৃশ্যমান করা, যা মানুষকে এক বা অন্য ধরনের দিকে তাকাতে এবং নিজের কাছে সহজলভ্য উপায়ের মধ্যে এসব ধরন বা অন্য শৈলীর একীভূতকরণ চিহ্নিত করতে তাড়িত করেছে। পদ্ধতি হবে বিভিন্ন সময়ের ইমারতগুলো নির্বাচন করা, নিজস্ব গাঠনিক উপাদান দিয়ে সেগুলো বিশ্লেষণ করা এবং কোনো একটি শৈলীর বিবর্তন বা কয়েক শতকের সময় আবর্তে বিকশিত হওয়া শৈলীগুলো চিহ্নিত করা। ফলাফল কোনো একটি সুনির্দিষ্ট স্থানের ইমারতগুলোর ওপর করা একটি চূড়ান্ত মনোগ্রাফ হবে না, যেমনটা ক্রেইগটন, র্যাভেনশ ও আবিদ আলী করেছেন কিংবা নিজস্ব আন্তঃসংযোগ দেখার জন্য একটি জ্যামিতিক পরিকল্পনা প্রকল্পে ইমারতগুলোকে পর্যবসিত করা হবে না, যেমনটা এম এম চক্রবর্তী এবং এস কে সরস্বতী করেছেন। বরং ফলাফল হবে বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়ার একটি মূল্যায়ন বিনির্মাণ করা, যা স্থানীয় ভূগোল, ঐতিহ্য ও সময়ে সময়ে গৃহীত বিদেশী প্রভাবের প্রাসঙ্গিকতায় ইমারতগুলো সৃষ্টির অবস্থা বা শর্ত হাজির করে। এখানে আমাদের প্রচেষ্টা নিছকই ইমারতগুলো বর্ণনা করা নয় কিংবা কেবল কতগুলো জ্যামিতিক আকারে সেগুলোকে পর্যবসিত করা নয়; বরং একটি নির্দিষ্ট অবস্থার মধ্যে স্থাপত্যিক প্রকাশের জন্য মানুষের প্রচেষ্টার গল্প বোনা এবং এসব প্রকাশ বা অভিপ্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলায় উদ্ভূত অভিনব ও স্বতন্ত্র একটি স্থাপত্যশৈলীর বিবর্তন ফিরে দেখা।


নির্মাণ উপকরণ

বাংলায় সহজপ্রাপ্য উপকরণ হলো খুবই চমৎকার বিন্যাসের পলল মাটির কাদা, যেটি সুপ্রাচীন কাল থেকে ঘর নির্মাণ এবং অলংকরণের উদ্দেশ্যে পোড়ামাটি হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছে। হাতের কাছে থাকা পাথরের একমাত্র উৎস মালদা জেলার রাজমহল পাহাড়ের কালো পাথর। খুব কমই বিহার থেকে বেলেপাথর এবং গ্রানাইট আমদানি করা হতো। বাংলার ইমারত শিল্পে ইট স্থাপত্যের প্রাধান্য বেশি, এখানে পাথর গৌণ উপকরণ হিসেবে কাজ করেছে। এটি এজন্য যে বাঙালি স্থাপত্য ‘ইট রীতি’ হিসেবে বর্ণিত হয়ে এসেছে। স্থানীয় স্থপতিদের কাছে পাথরের মান ভালোভাবে জানা ছিল, এর শক্তি স্বীকারপূর্বক যারা খিলান ও গম্বুজের সাপোর্ট হিসেবে পাথরকে ব্যাপকভাবে খুঁটিতে পরিণত করেছে। তবে প্রায়ই দেয়ালের বহির্ভাগ হিসেবে পাথরের ফলক ব্যবহার করা হতো, যার অভ্যন্তরভাগ ছিল ইটের তৈরি। নির্মাণের এই দ্বিতীয় পদ্ধতিকে আমার গ্রন্থে ‘ইট ও পাথর রীতি’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। শেষোক্ত পদ্ধতি বাংলায় মুসলিমদের নতুন উদ্ভাবন নয়। এটি এ উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে অনুসরিত হয়েছে এবং কুতুবউদ্দিন আইবেক কর্তৃক দিল্লিতে কুতুব মিনার নির্মাণের প্রথম দিকেই এটি দেখা যায়। দ্বিতীয় পদ্ধতি বা শৈলী ব্যয়সাশ্রয়ী এবং একই সঙ্গে দেয়ালের উপরিতলকে (সারফেস) পারিবেশিক আর্দ্রতা থেকে রক্ষা করে, যা বাংলায় খুবই সাধারণ বিষয়। অধিকন্তু পাটাতনের ভেতরের আর্দ্রতা থেকে ইটকে সুরক্ষায় সাধারণত গোবরাটের সঙ্গে দেয়ালের একই স্তরে পাথর ফলক জুড়ে দেয়া হয়। উদাহরণ কম থাকায় প্রাক-মুসলিম স্থাপত্যে এ পদ্ধতি অনুসরিত হয়েছে কি হয়নি, তা বলা মুশকিল। তবে চুন-সুরকির ব্যবহারই হলো প্রাক-মুসলিম থেকে মুসলিম আমলের ইট স্থাপত্যকে মৌলিকভাবে তফাত করে। চুন হিন্দুদের কাছে জানা ছিল এবং মেঝে জমাটবদ্ধকরণে এটি তারা ব্যবহার করত, যেমনটা মহাস্থানের খননে প্রমাণ মেলে; কিন্তু প্রাক-মুসলিম আমলে মসলা হিসেবে চুনের ব্যবহার অনেকটাই অজানা ছিল। প্রকৃতপক্ষে হিন্দুদের অনুসরিত নির্মাণ কৌশলে এ ধরনের আঠালো মসলা ব্যবহারের প্রয়োজন ছিল না। স্থাপত্যে ইট বা পাথরের ব্যবহার নির্ভর করত তা পুরোপুরিভাবে সারফেসে সরল ভঙ্গিতে শুয়ে থাকার ক্ষমতার ওপর; নিছক ওজন দ্বারা কাঠামোর ভারসাম্য বজায় রাখা হতো। একটি মসৃণ মুখ (স্মোথ ফেস) এবং খুবই সূক্ষ্ম ও চমৎকার সন্ধি (জয়েন্ট) থাকা জরুরি ছিল, যাতে একটি পাথর অন্যটির পুরো ভার সহজেই নিতে পারে। কারিগরিভাবে আনুভূমিক বিম ও উল্লম্ব লিন্টেলের নির্মাণ নামে পরিচিত এই পদ্ধতি মুসলিমদের কর্তৃক বাদ দেয়া হয়েছিল, যারা প্রকৃত খিলান, গম্বুজ ও খিলান ছাদ নির্মাণের ঐতিহ্য আমদানি করেছিল, যেটিতে পুরো স্থাপত্যে একত্রে বাঁধতে মসলা প্রভাবক অংশের ভূমিকা রেখেছিল। মসলার ব্যবহার চূড়ান্তভাবে ইটের আকার হ্রাসে অবদান রেখেছিল, যাতে স্থপতি অধিক কার্যকর হতে পারে। চুন-সুরকি পলেস্তারা হিসেবেও ব্যবহূত হয়েছিল, দালানকে পানিরোধী করার উদ্দেশ্যে বিশেষত প্রাচীর, ছাদ ও গম্বুজে। মোগল আমলে পলেস্তারা দেয়ালের উপরিতলেও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। খ্রিস্টীয় ১৫ শতকের শুরুর দিকে আমরা বাংলায় চকচকে টালির ব্যবহার দেখতে পাই। সেগুলো এক বা বহু বর্ণের। আবার কিছু কিছুতে ফুলেল অলংকরণের দেখা মিলত। নকশায় যেভাবে বিভিন্ন ধরনের চকচকে টালির ব্যবহার সুনির্দিষ্ট অংশ হয়ে উঠেছিল, তাতে প্রমাণ মেলে যে সেগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হতো।


মৌলিক আকার হিসেবে বাঁশের রীতি (ব্যাম্বু স্টাইল)

উপরে উল্লিখিত ইটের রীতি আবশ্যিকভাবে এটি বোঝায় না যে বাঙালি স্থাপত্যের মৌলিক আকার ইট থেকে এসেছিল। ইটের ইমারতগুলো বাংলায় ব্যতিক্রম ছিল, সেগুলো সাধারত শহর এলাকায় দেখা যেত। বাংলার অধিকাংশ জনগোষ্ঠীই বাঁশের তৈরি ছনের ছাউনির ঘরে বাস করত। অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা কাঠের স্থাপত্যে বাঁশের রীতি আরোপ করেছিল এবং বাংলায় পরবর্তী সময়ে উভয় ধরনই ইটের রীতিকে প্রভাবিত করেছিল। তবে একগুচ্ছ ঐতিহ্য নিয়ে মুসলিমরা এখানে এসেছিল এবং তারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর তাদের নির্মাণ পদ্ধতি বা কৌশল আরোপ করেছিল। ধীরে ধীরে মুসলিম স্থাপত্য স্থানীয় প্রভাব অনুভব করল; বাংলায় একটি অভিনব ও স্বতন্ত্র শৈলী বিবর্তনে ভূমিকা রেখেছিল। অবশ্য মুসলিমদের সহজপ্রাপ্য সম্পদ দিয়ে স্থাপত্য নির্মাণ করতে হতো এবং যখন আমরা সেগুলো পুরোপুরিভাবে বিশ্লেষণ করি, তখন বাংলায় মুসলিম স্থাপত্যের উত্পত্তি বুঝতে পারি। তিন প্রধান বিষয়ের ভিত্তিতে সেগুলো আমরা বুঝতে পারি। এক. স্থাপত্যিক ধরন বা আকার; দুই. স্থাপত্যিক নকশা এবং তিন. নির্মাণকার্যে ব্যবহূত উপাদান।

স্থাপত্যিক আকার

বাংলায় আসা যেকোনো পরিব্রাজকই এখানে সব জায়গায় বাঁশঝাড় দেখতে পাবে। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এ প্রাকৃতিক উপহার এখানকার মানুষ বসবাসের ঘর তৈরিতে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে এসেছে। গ্রামে আমরা বাঁকানো ছাদ ও টানার চালার বাঁশের তৈরি ঘর দেখতে পাই। এই ছাদগুলো দুই ধরনের। এক. চৌচালা ধরন, যার চারটি পার্শ্ব থাকে এবং দুই. দোচালা, যার দুটি পার্শ্ব থাকে। বাঁশের ক্ষেত্রে ছাদের ঢাল এতটাই প্রাকৃতিক যে বাঙালি চোখ এতে অভ্যস্ত এবং এই বক্রাকৃতি তাদের রুচির অভিপ্রকাশ। তবে বাঁশের এ ধরন মুসলিম আমলে ইটে রূপান্তরিত হয়েছিল। চৌচালা ধরন বাগেরহাটে অবস্থিত খ্রিস্টীয় ১৪৫৯ সালের দিকে নির্মিত ষাটগম্বুজ মসজিদে দেখা যায় এবং দোচালা স্থাপত্য শাহজাহানের সময় থেকে দেখা যায়। কার্নিশ ও প্রাচীরের বক্রাক্তি জালালউদ্দিন মোহাম্মদের সময় থেকে একটি সাধারণ বিষয় হয়ে এসেছে, যতক্ষণ পর্যন্ত সাম্রাজ্যিক বা কেন্দ্রীয় মোগল শৈলী দ্বারা তা বাদ না যায়।

স্থাপত্যিক নকশা

সময়ের আবর্তে উন্নয়ন হওয়া অদ্ভুত ও অভিনব বাঙালি নকশা বাঁশের তৈরি কুঁড়েঘর থেকেও অনুপ্রেরণা পায়। এসব কুঁড়েঘরে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এক. বাঁশের দীর্ঘ কর্ণ দ্বারা একত্রে বাঁধা বাঁশের চারটি কোণের খুঁটি। এসব খুঁটির ওপর কুঁড়েঘরের প্রধান কাঠামোটি দাঁড়িয়ে থাকে। জালালউদ্দিন মোহাম্মদের সময়ে উন্নয়ন হওয়া সাধারণ বাঙালি রীতির এসব খুঁটি পরবর্তী সময়ে কর্নার টাওয়ারে (বুরুজ) রূপান্তরিত হয়েছিল, যেগুলো বেশ লক্ষণীয়তা পায় এবং সেগুলো পুরো ইমারতকে একত্রে বেঁধে রাখে। দুই. একই উৎস থেকে দ্বিতীয় যে বৈশিষ্ট্য উদ্ভূত হয় তা হলো বিকল্প কুলুঙ্গি এবং উদ্গত অংশ, ঠিক যেমন কাঠ ও বাঁশের কুঁড়েঘরে দেখা যায়। সাদৃশ্যে জোর দেয়ার জন্য স্থপতি দেয়ালের মাঝখানে একটি টানা মোল্ডিং প্রদান করে, যেটি আমরা কুঁড়েঘরের মাঝখানে দরজার লিন্টেলের পর্যায়ে একটি দীর্ঘ বাঁশের খুঁটি দেখতে পাই।

নির্মাণকার্যে ব্যবহৃত উপাদান

এটি বলা মুশকিল বাংলায় মুসলিম স্থাপত্যে সুনির্দিষ্ট কোন উপাদান বিশেষ অবদান রেখেছে। হাভেল সুচিমুখী খিলান, মিহরাব এবং গোল খিলানের ওপর বিশেষ জোর দিতে পছন্দ করেন। তবে এসবের মধ্যে শেষোক্তটি মুসলিম বিশ্বে এত সাধারণ বৈশিষ্ট্য যে এটি বাংলার কিনা নিশ্চিতভাবে অবিচল থাকা কঠিন। অবশ্য পার্শ্ব খুঁটি থেকে ঝোলানো দুই কেন্দ্রমুখী খিলানের প্রতি অনুরুক্তি মনে হয় বাঁশরীতির একটি স্বাভাবিক কাউন্টারপার্ট হতে পারে; যেখানে দুটি বাঁশের একত্রে বাঁধন কঠোরভাবে এই ধরন বা স্থাপত্যরীতি তৈরি করে। একইভাবে পুরনো মালদার গুণমন্ত মসজিদ এবং জামি মসজিদে দেখা যাওয়া পিপাসদৃশ খিলান করা ছাদ আবারো বাংলার নৌকায় ব্যবহূত বাঁশের তৈরি ছইয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। আদিনা মসজিদের মিহরাবে দেখা যাওয়া গোল খিলান ভারত উপমহাদেশে মুসলিম স্থাপত্যে ব্যবহূত এ ধরনের প্রথম দিককার উপাদান। বাংলার অধিকাংশ ইমারতে এ বৈশিষ্ট্য সাধারণভাবে দৃশ্যমান। বাংলার বাইরে দিল্লির সম্রাট শাহজাহানের এর প্রতি আকর্ষণ ছিল এবং তিনি এটি মোগল ইমারতগুলোয় আরোপ করেছিলেন। কিন্তু বাংলার অবদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য মুসলিম স্থাপত্যে নতুন উপাদান সংযোজন নয়, বরং বিদ্যমান মুসলিম উপাদানগুলো বাংলার রুচি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মেলানো। বিদেশী উপাদানগুলোকে ধীর রূপান্তরের মাধ্যমে স্থানীয় ভৌগোলিক চরিত্র, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আত্তীকরণ করেছে, তার নামই পরবর্তী সময়ে বাংলারীতি দাঁড়িয়েছে। বাংলারীতি এমন এক রীতি, মুসলিম ঐতিহ্যের গভীরে যার শেকড় প্রোতিত এবং মুসলিমদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে যার কারিগরি সম্প্রসারণ ঘটেছে। আবার একই সঙ্গে সাম্রাজ্যিক বা কেন্দ্রীয় মোগলরীতির আরোপন কিংবা ব্রিটিশ আমলে ইউরোপীয় স্থাপত্যের বিপর্যয়কর প্রভাবে যার বিলয় ঘটেছে।


পাথর দ্বারা অলংকরণ


প্রাক-মুসলিম আমলে হিন্দু ও বুদ্ধ কারিগররা আয়তাকার বড় বড় পাথর ফলক তৈরি করত এবং তাতে বিভিন্ন দেব-দেবীর স্তুতিচিত্র উত্কীর্ণ করত। এই স্তুতিকর্ম বাংলার সবচেয়ে প্রিয় শৈল্পিক অন্বেষণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় উন্নয়নকৃত এটি ছিল একটি উত্তারাধিকার শিল্প। একই ধরনের পাথরের কাজ মুসলিম শাসনামলেও অব্যাহত থাকে, কেবল স্তুতিচিত্রের জায়গায় অলংকারমূলক বিমূর্ত মোটিফ প্রতিস্থাপন হয়। দেয়ালের প্যানেল সজ্জা হিসেবে ব্যবহারে এসব আয়তাকার ফলকের ব্যাপক চাহিদা ছিল। মাঝে মাঝে খুঁটি বা স্তম্ভগুলোতেও আলংকারিক ব্যান্ড এবং অন্য গতানুগতিক নকশা দেখা যেত। মুসলিম আমলে মিহরাব পাথরের সজ্জা এবং কাঠের কাঠামো ও লিন্টেল খোদাইয়ে নতুন উন্নয়ন দেখা যায়, যেখানে আমরা বিভিন্ন ধরনের ফুলের প্রতিফলন লক্ষ করি। ছোট সোনামসজিদে দেখা যাওয়া স্ক্রল ওয়ার্ক খুব স্বস্তিদায়ক ছিল। তবে খুব স্বল্প সময়েই এই পাথর কাটার শিল্পকর্ম বিলয় ঘটে। কুসুম্বা মসজিদে আমরা মোটিফ কমই চিনতে পারি, উপরিভাগ (সারফেস) পরিপূরণে ঢেউ খেলানো রেখা ও বিন্দুর সমন্বয় ছাড়া। পাথর খোদাইয়ের সবিস্তার নিরীক্ষার এক গবেষণায় স্পষ্টভাবে দেখা গেছে যে এ ধরনের কাজগুলো পোড়ামাটির অলংকরণ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এটি একটি অনুকরণমূলক শিল্প। মোগলদের আগমনে এ পাথরকর্মের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। এমনকি তাদের ইমারতে পাথরের খুঁটিও বাদ দেয়া হয়েছিল। কেবল ঢাকায় অবস্থিত বিবি পরীর সমাধিসৌধে সাদা মার্বেল পাথর গ্রিল, দেয়াল এবং সমাধি কাঠামোয় ব্যবহূত হয়েছিল; যা পরবর্তী সময়ে পাথর খোদিত কাজের জীর্ণ অবস্থার সাক্ষ্য বহন করে।


কারিগরি ঐতিহ্য


আনুভূমিক ও উল্লম্ব ভঙ্গিতে একটি পাথরের ওপর আরেকটি পাথর দ্বারা নির্মিত দালানের হিন্দু ঐতিহ্য মুসলিম ইমারতে কম জনপ্রিয় ছিল; যেখানে প্রকৃত খিলান, খিলানছাদ ও গম্বুজরীতি বেশি অনুসরণ করা হয়। প্রাপ্ত উদাহরণগুলোয় নির্মাণের হিন্দু থেকে মুসলিম রীতির রূপান্তর কীভাবে ঘটেছিল তা জানা যায় না। দিল্লিতে কুতুবউদ্দিন আইবেক কর্তৃক নির্মিত কুইয়াতুল ইসলাম মসজিদে রূপান্তর পদ্ধতি সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। তবে এখানে বাংলায় প্রথম দিককার প্রায়ই সব ইমারতই ধ্বসংপ্রাপ্ত হয়েছে। অবশ্য ঢাকায় অবস্থিত বিবি পরীর সমাধিসৌধের মতো পরবর্তী ইমারতে আমরা হিন্দু ঢঙের উপরে জড়ানো পাথরে নির্মিত ছাদ দেখতে পাই। ছাদে পরিষ্কারভাবে এ পদ্ধতির দেখা মেলে; যদিও এর একেবারে উপরের অংশে একটি কৃত্রিম তামার তৈরি গম্বুজ বিদ্যমান। অন্য মুসলিম ইমরাতগুলোয় আমরা প্রকৃত খিলান, গম্বুজ ও খিলানছাদ দেখতে পাই। প্রাক-মোগল ইমারতগুলোয় আমরা সবসময় টো সেন্টার্ড ও সুচিমুখী খিলান দেখি এবং ভারী পিলপা থেকে সেগুলো ঝোলানো থাকে, কিংবা পরবর্তী সময়ে এক্ষেত্রে পাথরের খুঁটি থাকা সবচেয়ে সাধারণ বৈশিষ্ট্য। মসজিদের সম্মুখ অংশ হিসেবে আদিনা মসজিদে সরাসরিভাবে দেয়াল থেকে ঝোলানো খিলানগুলোর একটি পর্দা প্রবর্তন করা হয়েছিল। গম্বুজ সাধারণ অর্ধগোলাকার এবং কোনো কাঁধ নেই এবং খুব একটা উঁচুও নয়। গম্বুজের ভার নির্ভর করে খুঁটির ওপর; যদিও অন্তর্বর্তী সময়ের (ট্রানজিশন) পর্যায়ে তা সাধারণত করবেলড পেন্ডেন্টিভের ওপর সংস্থাপিত থাকে। প্রথমবারের মতো গুমতি গেটে আমরা বাংলায় স্কুইঞ্চের আবির্ভাব দেখতে পাই। গৃহকোণের পেন্ডেন্টিভ ব্যাপকভাবে সজ্জিত করা হয়। প্রাক-মোগল ইমারতগুলোয় হলকক্ষ বর্গাকার বেতে (বে মানে দুই স্তম্ভ দেয়াল প্রভৃতির মধ্যবর্তী স্থান) বিভাজিত এবং প্রতিটি বেতে চারটি পাথরের খুঁটি বিদ্যমান। যদি বে আয়তাকার হয়, যেমনটা ছোট সোনামসজিদে, তাহলে ছাদের আকৃতি বাঙালি কুঁড়েঘরের চৌচালা ধরনের মনে হয়। প্লাস্টার্ড ওয়ালস, শোল্ডার্ড ডোম, ফোর-সেন্টার্ড পয়েন্টেড আর্চ এবং হরাইজন্টাল প্যারাপেটস ফেসড উইথ ব্লাইন্ড মেরলোনের দিক থেকে মোগল ইমারতগুলো আগের ইমারতগুলোর চেয়ে স্পষ্টভাবে পার্থক্যসূচক, স্বতন্ত্র। গম্বুজ দাঁড়িয়ে থাকে একটি কাঁধের ওপর এবং এখানে এটি উচ্চতা অর্জন করে। সাপোর্ট হিসেবে এর কোনো পাথরের খুঁটি থাকে না। সাধারণত কেন্দ্রীয় গম্বুজ পার্শ্ববর্তী গম্বুজের চেয়ে বড় হয়, এই হ্রাসকরণ বিভিন্ন পদ্ধতিতে অর্জন করা হয়; স্পষ্টভাবে যা ঢাকার মসজিদগুলোয় দেখা যায়। মসজিদের অভ্যন্তরভাগ ট্রান্সভার্স আর্চ দ্বারা তিনটা অংশে ভাগ করা হয় এবং প্রতিটি অংশ গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে। কিছু ইমারত (যেমন ঢাকার হাজি খাজা শাহবাজের সমাধি) আমরা সরলভঙ্গির খিলানের ব্যবহারও দেখি। মাল্টিফয়েল খিলানের সঙ্গে সরলভঙ্গির খিলান ১৭ শতকের শেষের দিকে ঢাকার ইমারতগুলোয় আলংকারিক সজ্জা হিসেবে সাধারণভাবে সম্মিলন ঘটানো হতো।


(মুসলিম আর্কিটেকচার ইন বেঙ্গল গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপে ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির)


 


আহমদ হাসান দানী: ইতিহাসবিদ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন