পোড়ামাটির নকশায় প্রকৃতি

জাকিয়া রহমান ঋতা

 দেশে প্রাচীনকালের সমাজ স্থাপত্যের ধারা নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রথম পর্বে প্রকাশিত হয়েছে। এবারের বিষয় মধ্যযুগ। প্রাক-ইসলামিক বৌদ্ধ হিন্দু সামাজিক ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল কখনো সমান্তরালভাবে, কখনো আগে-পরে। তাছাড়া তাদের ধর্মবিশ্বাস রীতিনীতির মধ্যে কিছু পারস্পরিক প্রভাব কার্যকর ছিল। বাংলার মধ্যযুগ মূলত দেশে মুসলিম শাসনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সুদূর তুরস্ক থেকে মুসলমানরা কীভাবে দেশে এল, জয় করল এরপর শাসন করে আধিপত্য বিস্তার করল প্রসঙ্গে কিছু প্রাক-আলোচনা ভূমিকা হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। তা সে সময়ের স্থাপত্যধারা বোঝার জন্য সহায়ক। পাল রাজাদের সময় ছিল বাংলার গৌরবান্বিত এক স্বর্ণালী সময়। স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থা সর্বোপরি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের সহনশীল সহাবস্থানের অসাধারণ পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করেছিল একটি অনবদ্য সামাজিক সাংস্কৃতিক বিকাশধারা। শিল্প-সাহিত্য-স্থাপত্য এসব শাখায় এসেছিল উন্নতমানের সৃষ্টিশীল জোয়ার। রকম একটি পরিবেশ মানসিকতার উদার খোলা আকাশ সভ্যতা বিকাশের জন্য যে কতটা প্রয়োজন, আজ তা জীবনের পরতে পরতে উপলব্ধি করা যায়।

সময় কিংবা পরিস্থিতি চিরপরিবর্তনশীল, তা সে ব্যক্তি-সমাজ জীবনেই হোক কিংবা স্থানবিশেষের। প্রকৃতির একই নিয়মে বাংলার মাটিতে উপরে উল্লেখিত এই উজ্জীবনের ধারাও অব্যাহত থাকেনি। পাল সেন বংশের শেষদিকে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার কড়াকড়ি, শাসনব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের রূঢ়তা প্রভৃতি কারণে সমাজের পীড়িত, নিম্নবর্ণের বা সমাজের নিচের স্তরের মানুষের অবস্থা ক্রমেই অবনতির ঢালে পতিত হতে থাকে। বাণিজ্যের পরিবর্তে কৃষির গুরুত্ব বাড়তে থাকার পাশাপাশি সামন্ত প্রভুদের দাপটপূর্ণ কর্তৃত্ব শোষণের কারণে দরিদ্র, ভূমিহীন চাষী সাধারণ মানুষের জীবন হয় দুর্বিষহ, দেখা দেয় অসম সমাজের হাহাকার ধ্বনি। বাংলার সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যখন হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেন আমলের প্রভাব, ততদিনে ভারতের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে উদ্ভূত নতুন ধর্ম ইসলামের আবির্ভাব ঘটে গেছে। সেই ধর্ম মানুষের সমতার কথা বলে। বাংলায় এই নতুন ধর্মের প্রভাব দেখা যায় আরো পরে। অষ্টম শতকের শুরুর দিকেই মুসলমানদের সিন্ধু বিজয়, কিন্তু বাংলায় তখনো পাল বংশের শাসন। দশম শতকের হিন্দু রাজত্বের সময় পাহাড়পুর ময়নামতি এলাকায় আরবের মুসলমান বণিকরা বাংলায় এসেছেন বাণিজ্য করতে, সেই সঙ্গে একাদশ শতকের মধ্যে বহু মুসলমান ধর্মপ্রচারক, সুফি-সাধক অঞ্চলে প্রবেশ করেছিলেন এবং অনেকে এখানে বসতিও স্থাপন করেন।

ত্রয়োদশ শতকের প্রথম ভাগ। বাংলার মাটিতে তখন বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেনের শাসন। তিনি তখন তীর্থস্থান নদীয়ায় বাস করছেন। উচ্চরাজকর্মচারীদের মধ্যে রাজকার্যে খানিক শৈথিল্য। এদিকে কড়া শাসনের বদলে সমাজে ধর্ম, সাহিত্য বা জ্যোতিষবিদ্যার ওপর আগ্রহ বাড়ছে। বাংলার আকাশে একধরনের পরিবর্তনের ডাক। সেই রকম এক সময়ে, তীক্ষ বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি বিনা বাধায় বাংলার নদীয়ায় প্রবেশ করেন; ইতিহাসের সেই গল্প আমাদের সবারই কম-বেশি জানা। ১৭ জন অশ্বারোহী সঙ্গী কৌশল কাজে লাগিয়ে বখতিয়ার খলজি নদীয়া দখল করেন। পরিবর্তিত হয় দেশের রাজনীতির পট। সময়টা ছিল ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ। এর পর থেকে বাংলার মুসলিম শাসন শুরু। এই সমৃদ্ধিশালী উন্নত সংস্কৃতির দেশে ভাগ্যান্বেষণে আসতে থাকে অনেকে। রাজকর্মচারী, সৈন্য, ব্যবসায়ী ছাড়াও দেশে আগমন হয় নানা পেশাদার ব্যক্তি বুদ্ধিজীবীদের। নানা দেশের নানা সমাজের মুসলমান, বাংলার প্রাচীন অধিবাসী, হিন্দু-বৌদ্ধএসব মিলিয়ে সোনার দেশে উদ্ভব হয় এক মিশ্র সংস্কৃতির। স্থাপত্যেও সেই বিচিত্রতার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন