বঙ্গীয় স্থাপত্য ও হাওড়ের জগন্মোহনী সম্প্রদায়

শিশির হক

স্থাপত্য শিল্পে বাংলার রয়েছে নিজস্ব অবদান। দেয়ালের ওপর বাঁশের ফ্রেমে ছন খড় দিয়ে তৈরি হতো এখানকার পরিবেশ আবহাওয়া উপযোগী কুঁড়েঘর। ছাদ নির্মাণের সময় চালটিকে চ্যাপ্টা না করে এর প্রান্তসীমা বাঁকা করে বক্রাকার রূপ দেয়া হয়। ঢালু অংশের সংযোগস্থলে উত্তোলিত রেখাও বক্রাকার হয়। স্থাপত্য শিল্পে বাংলার কুঁড়েঘরের ছাদের এই শৈলীবঙ্গীয় স্থাপত্য রীতি’, ‘বাংলা স্থাপত্য রীতি’, ‘বেঙ্গল স্টাইলইত্যাদি নামে পরিচিত। প্রত্নতত্ত্ববিদ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বঙ্গীয় স্থাপত্য রীতিকেবাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদবলে উল্লেখ করেছেন।

বঙ্গীয় স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করে নির্মিত পাকা ভবন চালার প্রেক্ষিতে দোচালা, চৌচালা, আটচালা, বারোচালা ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত। দুই ঢালু চালবিশিষ্ট ভবনকে বলা হয় দোচালা। চার ঢালু চালবিশিষ্ট ভবনকে চৌচালা বলে। চৌচালা ঘর সাধারণত বর্গাকার ভিত্তির ওপর স্থাপিত। চৌচালা ছাদের ওপর অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর চৌচালা ছাদের কাঠামো জোড়া দিয়ে আটচালা ভবন নির্মাণ করা হয়। ভবনের সংখ্যার বিচারে পরিচিত একবাংলা জোড়বাংলা নামে। দুই ঢালু চালবিশিষ্ট দোচালা ঘর একবাংলা নামে পরিচিত। পাশাপাশি দুটি দোচালা মিলে হয় জোড়বাংলা।

আবহমান কাল থেকে বাংলাদেশে রীতি প্রচলিত বলে পণ্ডিতদের ধারণা। স্বাধীন সুলতানি আমলে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বঙ্গীয় স্থাপত্য রীতি চর্চিত হয়েছিল। সুলতানি আমলেম সজিদের ছাদে গম্বুজের সঙ্গে স্থাপন করা হয় বঙ্গীয় স্থাপত্য রীতির কাঠামো। বাগেরহাটের ষাটগম্ভুজ মসজিদের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথ মিহরাবের মধ্যবর্তী স্থানের ওপরের আচ্ছাদন বাংলাদেশের চৌচালা ঘরের চালের আকারে নির্মিত সারিবদ্ধ সাতটি কাঠামো। চৌচালা কাঠামোর উত্তর দক্ষিণ দিকে রয়েছে গম্বুজ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছোট সোনামসজিদের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথ মিহরাবের মধ্যবর্তী স্থানের ওপরে রয়েছে তিনটি চৌচালা কাঠামো। চৌচালা কাঠামোর উত্তর দক্ষিণ দিকে রয়েছে ১২টি গম্বুজ। সুলতানি আমলে মন্দির, মসজিদ, মাজার, দরগাহ তোরণে কুঁড়েঘরের এই রীতি অনুসরণ করা হয়। মোগল নবাবি আমলেও বঙ্গীয় স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করে ভবন নির্মাণের প্রবণতা অব্যাহত ছিল। মোগল আমলে ঢাকায় নির্মিত চুড়িহাট্টা মসজিদ ছোট ভাট মসজিদের ছাদ ছিল চৌচালা। খাজা শাহবাজের মাজারসংলগ্ন ভবনে রয়েছে দোচালা ছাদ। বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদ কুলী খান নির্মিত বেগমবাজার মসজিদের দোতলায় উত্তর দক্ষিণ দিকে দোচালা রীতির দুটি কক্ষ রয়েছে।

ষোলো শতক পর্যন্ত বক্রাকার প্রান্তসীমাবিশিষ্ট ঢালু ছাদ বাংলার বাইরে দেখা যেত না। মোগল সম্রাট শাহজাহানের সময় এই রীতি উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহী যুবরাজ হিসেবে তিনি ঢাকায় কিছুদিন বসবাস করেন। ক্ষমতায় আরোহণের পর তিনি রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তর করেন। দিল্লিতে তার নির্মিত লালকেল্লা দুর্গে বঙ্গীয় স্থাপত্য রীতির ভবন ছিল। দেওয়ান--খাস আসনের উপরে ছাদ নির্মাণ করা হয় বঙ্গীয় স্থাপত্য রীতিতে। এরপর রীতি লাহোর, রাজস্থানসহ বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে।

বিশ শতকে সারা বিশ্বে বারান্দাসহ একতলা ভবন বাংলো নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে।

");

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন