টেরাকোটা- পর্ব ২

বাংলাদেশের প্রাপ্ত হাম্মামের সংখ্যা ছয়টি। কোনো নির্দিষ্ট ধরনের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য আলোচনায় এ সংখ্যা অপ্রতুল। তবে হাম্মাম এমন এক ধরনের সেকুলার স্থাপত্য, যা শুধু বিশেষ রাজকীয় ইমারতের সঙ্গেই নির্মিত হতো। বাংলাদেশের সাধারণ বা ধনাঢ্য মানুষের বাড়িতে হাম্মাম তৈরির প্রবণতা দেখা যায়নি। ফলে এ ধরনের ইমারতের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই কম। স্বল্পসংখ্যক এ ইমারতগুলোয় আকার ও গঠনগত কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও প্রকৃতিগতভাবে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। এখানে বাংলাদেশের হাম্মামগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো—

প্রথমত, বাংলাদেশের হাম্মামের দেয়াল চওড়া করে তৈরি হয়েছে। কোথাও কোথাও (যেমন সোনা মসজিদ অঞ্চল হাম্মাম) সম্পূর্ণ ইমারতের দেয়ালের পুরুত্ব বেশি না হলেও মূল স্নানাগার অংশে এ পুরুত্ব বেশি ছিল। জাহাজঘাটা হাম্মাম, সোনা মসজিদ অঞ্চল হাম্মাম ও জিনজিরা হাম্মামের দেয়াল সর্বোচ্চ র্৩র্ -র্০র্ , ঈশ্বরীপুর হাম্মামের দেয়াল সর্বোচ্চ র্৩র্ -র্৬র্ , লালবাগ দুর্গ হাম্মামের দেয়াল সর্বোচ্চ র্৪র্ -র্০র্  এবং মির্জানগর হাম্মামের দেয়াল সর্বোচ্চ র্৪র্ -র্৯র্  প্রশস্ত।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের হাম্মামগুলো নির্মাণে প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে ইট, চুন-সুরকি ও খোয়া। ইটগুলো মোগল বৈশিষ্ট্যের অর্থাৎ কম পুরুত্বের। ইটের দৈর্ঘ্য ৯.র্৫র্ -১০র্৫র্ , প্রস্থ ৫.র্৫র্ -৬.র্৫র্  এবং পুরুত্ব ১.র্৫র্ । এছাড়া কোথাও কোথাও পাথর ব্যবহূত হয়েছে।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশের সব হাম্মামে চতুর্কেন্দ্রিক খিলানের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। শুধু ঈশ্বরীপুর হাম্মামের সম্ভবত অর্ধবৃত্তাকার খিলান ব্যবহূত হয়েছিল। প্রশস্ত ও অপ্রশস্ত দুই ধরনেরই খিলান তৈরি হয়েছে। খিলানগুলো সাধারণভাবে প্রকৃত খিলান নির্মাণ পদ্ধতিতে বা ভূঁসোয়া পদ্ধতিতে তৈরি হয়েছে। শুধু লালবাগ দুর্গ হাম্মামের করবেল পদ্ধতিতে তৈরি খিলান দেখা যায়।

চতুর্থত, গম্বুজ নির্মাণে (Phase of transition) স্কুইঞ্চ পদ্ধতির ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের হাম্মামগুলোর গম্বুজ মজবুত করা হয়েছে, এতে এগুলোর স্থায়িত্বও নিশ্চিত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো ড্রামের ওপর স্থাপিত হয়েছিল। এতে গম্বুজগুলো ইমারতের সঙ্গে মানানসই এবং যথাযথ উচ্চতায় পৌঁছেছিল।

বাংলার চিরাচরিত বাঁশের কুঁড়েঘরকে ইট নির্মিত স্থাপত্যে রূপান্তর করতে মধ্যযুগের ইমারতে দোচালা বা চৌচালা ছাদ নির্মিত হয়েছিল। বাংলাদেশের হাম্মামগুলোও এ ধারার ব্যতিক্রম নয়। বিশেষত লৌকিক (Secular) স্থাপত্য হওয়ায় হাম্মাম নির্মাণে গম্বুজের অবস্থিতি আবশ্যিক ছিল না বিধায় প্রায়ই অনুরূপ ছাদ নির্মিত হয়েছিল। মির্জানগর হাম্মাম ও ঈশ্বরপুর হাম্মাম ব্যতীত বাংলাদেশের অন্যান্য হাম্মামে চৌচালাকার ভল্টেড ছাদ ব্যবহূত হয়েছে। এছাড়া জাহাজঘাটা হাম্মাম ও মির্জানগর হাম্মাম ব্যতীত সব হাম্মামে অর্ধগম্বুজ তৈরি হয়েছে। এগুলো খিলান নির্মাণের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে বলে অনুমিত হয়।

পঞ্চমত, বাংলাদেশের প্রতিটি হাম্মামে পানি সরবরাহ ও প্রবাহের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছিল। পানি প্রবাহিত করতে ব্যবহূত হয়েছিল পোড়ামাটির নল। এ নলগুলো দেয়াল গাত্রে এবং মেঝের নিচে অন্তঃপ্রবিষ্ট ছিল। এগুলো এমনভাবে স্থাপিত হয়েছিল যে দেয়াল বা মেঝের চাপে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা ছিল না।

বাংলাদেশের ছয়টি হাম্মামের চারটিতেই পানি সরবরাহের উৎস ছিল গভীর কূপ। ঈশ্বরীপুর হাম্মাম ও লালবাগ দুর্গ হাম্মামের পার্শ্ববর্তী নদী থেকে পানি সরবরাহ করা হতো। কূপ বা নদী থেকে পানি উত্তোলনে সম্ভবত কপিকল ব্যবহূত হতো।

বাংলাদেশের প্রতিটি হাম্মামে পানি সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছোট আকৃতির বদ্ধ কুঠুরিতে পানি সংরক্ষিত হতো। শুধু মির্জানগর হাম্মামে ছাদের ওপর বিশেষ ধরনের চারটি জলাধার নির্মাণ করা হয়েছিল। জিনজিরা হাম্মামে পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা স্পষ্ট না হলেও বর্তমান গ্রন্থাকার কিছু যুক্তির ভিত্তিতে একটি কক্ষকে পানি সংরক্ষণের কক্ষ হিসেবে শনাক্ত