২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক

ব্যক্তি খাতের মন্থরতা কাটেনি

নিজস্ব প্রতিবেদক

চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক পার হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই সরকারের ঋণ প্রবৃদ্ধি ২২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এর বিপরীতে সংকোচন ঘটেছে বেসরকারি খাতের ঋণ জোগানে। একই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক দশমিক ২৮ শতাংশ। প্রথম প্রান্তিকের রফতানিও আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৩ শতাংশ কমে গেছে। এ সময়ে সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভালো কিছুও যোগ হয়েছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে রেমিট্যান্স বেড়েছে সাড়ে ১৬ শতাংশের বেশি। প্রথম মাসেই ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে রাজস্ব আহরণে। ঘাটতি কাটিয়ে জুলাই শেষে চলতি হিসাবেও ২৪ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে। চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত হলেও কমেছে আমদানি প্রবৃদ্ধি। গত তিন মাসে উল্লেখযোগ্য পতন হয়েছে পুঁজিবাজারের সূচক ও বাজার মূলধনে। মূল্যস্ফীতিও খানিকটা বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেমিট্যান্স ও রাজস্ব আহরণে ভালো প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত অর্থনীতির স্বস্তির জায়গা। তবে রফতানি ও বেসরকারি খাতের ঋণের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ব্যক্তি খাতের মন্থরতাই নির্দেশ করছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, বেশ কয়েকটি সূচকের প্রবৃদ্ধি হয় নেতিবাচক, নয়তো শ্লথ। শুধু রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ভালো অবস্থানে রয়েছে। ব্যাংকিং খাত থেকে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার অর্থই হলো বিনিয়োগের ওপরও সেটির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ক্যাপিটাল গুডস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল র ম্যাটেরিয়ালের প্রবৃদ্ধিও নেতিবাচক। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের বিষয়টি তেমন প্রভাব ফেলবে না। কারণ বেসরকারি খাতে যেহেতু বিনিয়োগ হচ্ছে নাতাই ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের চাহিদাও কমেছে। একদিকে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট রয়েছে, অন্যদিকে ঋণের চাহিদাও কম। এ পরিস্থিতিতে সরকার ঋণ নিলে ব্যাংকগুলোর জন্য আয়ের একটা উৎস তৈরি হবে।

সরকারের ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়লেও ঋণাত্মক বেসরকারি খাতে : ২০১৯-২০ অর্থবছরের শুরুতেই ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ বেড়েছে। জুলাই-আগস্ট এ দুই মাসেই সরকার ঋণ নিয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে এ ঋণ ২২ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকার ঋণ নেয় ১৬ হাজার ৬৮৯ কোটি ও আগস্টে ৮ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা।


সরকারের ব্যাংকঋণ বাড়লেও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ঋণ গ্রহণ। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে হাজার ৬৫৯ কোটি টাকার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল যেখানে হাজার ৫৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি বমেছে ৫৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। একে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে সংকুচিত হয়েছে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ও ভোগে এর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিনিয়োগযোগ্য তারল্য থাকলেও ভালো গ্রাহক ও প্রকল্পের অভাবে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিস এ খান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংকিং খাত তারল্য সংকটের মধ্যে ছিল। তবে এ মুহূর্তে অনেক ব্যাংকের হাতেই বিনিয়োগযোগ্য তারল্য আছে। কিন্তু ভালো গ্রাহক ও ভালো ঋণ প্রস্তাব না থাকার কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারছে না।

রফতানিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি : অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেই হোঁচট খেয়েছে রফতানি খাত। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়েছে মোট ৯৬৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলারের পণ্য। গত অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে পণ্য রফতানি হয় ৯৯৪ কোটি ৬ লাখ ডলারের। এ হিসাবে রফতানি কমেছে ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। তৈরি পোশাক থেকে শুরু করে প্রধান প্রধান রফতানি খাতই এ সময় খারাপ করেছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বণিক বার্তাকে বলেন, মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে আমাদের রফতানি বেড়ে যাওয়ার কথা। পাশাপাশি কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্সও সারপ্লাস হওয়ার কথা। এর প্রভাবে অভ্যন্তরীণ ভোগও বাড়বে বলে আশা করা যায়। চ্যালেঞ্জ হবে আমদানির ক্ষেত্রে, মূলধনি যন্ত্র ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে যদি আমরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অবমূল্যায়নের দিকে যাই, তাহলে আবার মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ থাকবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি চ্যালেঞ্জগুলো সঠিকভাবে অ্যাড্রেস করতে পারে, তবে সামগ্রিকভাবে জিডিপি ও রফতানি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ভোগও বাড়ার কথা। সরকারের তরফ থেকে বাজেটের সময় একটা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছিল সংকট মুহূর্তের জন্য। বিরূপ পরিস্থিতিতে সেটাও কাজে লাগানো যেতে পারে।

কমেছে রিজার্ভ : রফতানির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধাক্কা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর পড়েছে। গত দুই বছর ধরেই রিজার্ভের প্রবৃদ্ধি নেই। গত ৯ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২১১ কোটি ডলার। যদিও এর আগে রিজার্ভ ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছিল।

পুঁজিবাজারে পতন: চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকেই দেশের পুঁজিবাজারে মন্দা চলছে। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানামুখী পদক্ষেপ ও সংস্কারেও বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরছে না। এর প্রভাবে ধারাবাহিক পতনের মধ্যে রয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। সর্বশেষ গত তিন মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৪৬০ পয়েন্ট। আর এ সময়ে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ২৬ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। সূচক ও বাজার মূলধন কমার পাশাপাশি ডিএসইর দৈনিক গড় লেনদেনেও ধস নেমেছে। এ বছরের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ডিএসইর দৈনিক গড় লেনদেন ছিল ৪২২ কোটি টাকা, যা গেল সপ্তাহে ৩১৯ কোটি টাকায় নেমে আসে।

মূল্যস্ফীতি সামান্য বেড়েছে : মূল্যস্ফীতি খানিকটা বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চলতি অর্থবছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর মধ্যেও রাজস্ব ও রেমিট্যান্সে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চলতি হিসাবে ঘাটতিও কাটিয়ে ওঠা গেছে।

রাজস্ব আহরণে ভালো প্রবৃদ্ধি  : অর্থবছরের শুরুতে রাজস্ব আহরণে ইতিবাচক চিত্র দেখা গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম মাসেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ১৫ হাজার ৪৩৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এ সময় রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি ছিল শূন্য দশমিক ৭১ শতাংশ।

নতুন বাজেটের কারণে কর আদায় ভালো হয়েছে জানিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, অগ্রিম করও ভালো এসেছে। সেই সঙ্গে নতুন ভ্যাট আইনের কারণে এখানেও অগ্রিম কর এসেছে। তবে আগস্টে ছুটির কারণে রাজস্ব আহরণে কিছুটা ধীরগতি থাকলেও তা সেপ্টেম্বরে কাটিয়ে উঠেছি। এছাড়া পদক্ষেপ হিসেবে আয়করের জরিপ করাচ্ছি। বিভিন্ন স্থানে কর্মকর্তাদের পাঠাচ্ছি। আমরা যাদের মনে করছি, যারা কর শনাক্তকরণ নম্বর পাওয়ার যোগ্য বা যারা কর দেয়ার যোগ্য কিন্তু দিচ্ছে না, তাদের কর শনাক্তকরণ নম্বর দেয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে এবার ভালো ফল পাওয়া যাবে।

রেমিট্যান্সে লক্ষণীয় প্রবৃদ্ধি : চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রেমিট্যান্সে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ৪৫১ কোটি ৮ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ১৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৩৮৬ কোটি ৮৮ লাখ ডলার।

চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত : প্রায় দুই বছর ধরে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল। তা কাটিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থেকে গেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে চলতি হিসাবের উদ্বৃত্তের পরিমাণ ২৪ কোটি ডলার।

আমদানি প্রবৃদ্ধি হ্রাস : চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত তৈরি হলেও কমে গেছে আমদানি প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ২৬ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে আমদানি হয়েছে ৪৮০ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, অর্থনীতিতে অনেকগুলো টানাপড়েন রয়েছে। মন্থরতাও রয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। রফতানি প্রবৃদ্ধি, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ও আমানত প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। পুঁজিবাজারের অবস্থাও ভালো নয়। রাজস্ব খাতে দুর্বলতার কারণেই সরকারকে ব্যাপকভাবে ঋণ নিতে হচ্ছে। তা সত্ত্বেও অনেক প্রকল্পেই তহবিলের সংকট তৈরি হচ্ছে। এর প্রভাবে কোনো কোনো প্রকল্পে কাজের গতিও কমে গেছে। এগুলো চিন্তার বিষয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন