ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়ম

কর্মচারীকে মালিক সাজিয়ে ১১৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ

নিজস্ব প্রতিবেদক

কর্মচারীকে মালিক সাজিয়ে কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে ৮৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা বের করে নিয়েছেন ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীর ভাই মাজেদুল হক (শামীম) চিশতী। বর্তমানে সুদসহ সেই ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে জালিয়াতির মাধ্যমে বের করে নেয়া এ অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ মেলায় কমিশন গত বৃহস্পতিবার মোট আটজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা অনুমোদন দিয়েছে।

দুদক অনুমোদিত মামলার আসামিরা হলেন মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী, তার ভাই মাজেদুল হক (শামীম) চিশতী, ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) একেএম শামীম, শাবাবা অ্যাপারেলসের মালিক মো. আবদুল ওয়াদুদ ওরফে কামরুল, এডিএম ডায়িং অ্যান্ড ওয়াশিংয়ের মালিক রাশেদ আলী, তনুজ করপোরেশনের মালিক মো. মেফতাহ ফেরদৌস, মোহাম্মদ আলী ট্রান্সপোর্টের মালিক মো. গোলাম সারোয়ার ও ক্যানাম প্রডাক্টসের মালিক ইসমাইল হাওলাদার।

দুদকের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ব্যাংকটির গুলশান শাখার গ্রাহক ওয়েলটেক্সের চেয়ারম্যান মাজেদুল হক চিশতী তার কর্মচারী আবদুল ওয়াদুদ ওরফে কামরুলকে মালিক সাজিয়ে শাবাবা অ্যাপারেলস নামের একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে ফান্ডেড ঋণ সুবিধার আওতায় ঋণ নেন, চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির এ ঋণের মোট দায় দাঁড়িয়েছে ১৫ কোটি ২৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। অথচ ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় থেকে বন্ধকি জামানত সম্পত্তির বিপরীতে দেড় কোটি টাকার ফান্ডেড ঋণসীমা মঞ্জুর করা হয়েছিল। এছাড়া নন-ফান্ডেড ঋণসীমা ১৫ কোটি টাকা নির্ধারিত থাকলেও ব্যাংকটির গুলশান শাখার ব্যবস্থাপক জিয়া উদ্দিন আহমেদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৩৯ কোটি ৯ লাখ ৬ হাজার টাকার ঋণসুবিধা দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে, যা এখন সুদাসলে ৪৫ কোটি ৫ লাখ ৫১ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। ঋণ প্রদানে এমন অনিয়ম হলেও ব্যাংকটির তত্কালীন এমডি কোনো ব্যবস্থাই নেননি। কারণ প্রকৃতপক্ষে ঋণের নামে এসব সুবিধা গ্রহণ করেছেন মাজেদুল হক চিশতী, যিনি ব্যাংকের প্রভাবশালী পরিচালক মাহবুবুল হক চিশতীর ভাই।

ব্যাংকের এ ঋণসুবিধা নিতে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ী ইউনিয়নসহ দোয়াইবাড়ী মৌজার ১৭৬ শতাংশ জমির সম্ভাব্য বাজারমূল্য দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ও ফোর্সড সেল ভ্যালু দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, যা ঋণের তুলনায় খুবই কম বলে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

একই পদ্ধতিতে মাজেদুল হক চিশতীর আরেক কর্মচারী মো. রাশেদ আলীকে মালিক সাজিয়ে তৈরি করা আরেক কাগুজে প্রতিষ্ঠান এডিএম ডায়িং অ্যান্ড ওয়াশিংকে ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটির গুলশান শাখা। চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির এ ঋণের মোট দায় দাঁড়িয়েছে ৫৫ কোটি ৫ লাখ ১১ হাজার টাকা। ব্যাংকের গুলশান শাখার তত্কালীন ব্যবস্থাপকের সহযোগিতায় এ অর্থ বের করে নেন মাজেদুল হক চিশতী।

এ ঋণ নিতে মর্টগেজ হিসেবে দাখিল করা মেশিনারির আনুমানিক মূল্য দেখানো হয় ৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এছাড়া গাজীপুরের দোয়াইবাড়ী মৌজার ৩৩০ শতাংশ জমির সম্ভাব্য বাজারমূল্য দেখানো হয় ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং ফোর্সড ও সেল ভ্যালু দেখানো হয় ৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা, যা দায়ের তুলনায় খুবই কম বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

এছাড়া ঋণপ্রস্তাবের বিপরীতে আলী ট্রান্সপোর্ট নামের একটি নতুন হিসাবের বিপরীতে ২ কোটি টাকার ওডি লিমিটের অনুমোদন করা হয়, যাতে মাহবুবুল হক চিশতীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল। এ প্রতিষ্ঠানটিকেও ২ কোটি টাকার ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ব্যাংকিং বিধিনিষেধ মানা হয়নি। ঋণের এ অর্থেরও শেষ গন্তব্যস্থল ছিল ওয়েলটেক্স লিমিটেড।

দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা জানান, ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মাজেদুল হক চিশিতীকে বারবার তাগাদা দিলেও তিনি তা পরিশোধ করেননি। মাহবুবুল হক চিশতী অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকিং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজের ভাইকে এ অর্থ আত্মসাতে সহায়তা করেছেন। এছাড়া ব্যাংকটির এমডি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ আত্মসাতে সহায়তা করেছেন।

২০১৭ সাল থেকে ফারমার্স ব্যাংকের জালিয়াতির ঘটনা অনুসন্ধান করছে দুদক। অর্থ আত্মসাতের বিভিন্ন অভিযোগে এর আগেও পাঁচটি মামলা হয়েছে। ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল করা একটি মামলার অভিযোগপত্রও দিয়েছে দুদক। অভিযোগপত্রে আসামি হিসেবে রয়েছেন মাহবুবুল হক চিশতীসহ (বাবুল চিশতী), মাহবুবুল হক চিশতীর স্ত্রী রোজী চিশতী, ছেলে রাশেদুল হক চিশতী, ফারমার্স ব্যাংকের চাকরিচ্যুত এসভিপি জিয়া উদ্দিন আহমেদ ও চাকরিচ্যুত ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মাসুদুর রহমান খান।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালে অনুমোদন পাওয়া ফারমার্স ব্যাংক যাত্রার পরই বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। আস্থার সংকটে আমানতকারীদের অর্থ তোলার চাপ বাড়ে। পরিস্থিতির অবনতি হলে পদ ছাড়তে বাধ্য হন মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মাহবুবুল হক চিশতী। বর্তমানে ব্যাংকটি পদ্মা ব্যাংক নামে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন