মাধ্যমিক শিক্ষা

বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ নেই গণিত ইংরেজির ৫৫% শিক্ষকের

সাইফ সুজন

দিনাজপুরের পূর্ণপাড়া মাধ্যমিক ইউনাইটেড বিদ্যালয়ের শিক্ষক আতিকুর রহমান। প্রায় ১০ বছর ধরে বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বিষয়ে পাঠদান করছেন এ শিক্ষক। কিন্তু তার বিষয়ভিত্তিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই। শুধু তিনি নন, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে আসা ৫৫ শতাংশ শিক্ষকেরই বিষয়ভিত্তিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।

মাধ্যমিক শিক্ষকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, আয় ও কর্মসন্তুষ্টি, কর্মভার ও শ্রেণী কার্যক্রম তত্ত্বাবধান, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষণ-শিখন, মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার, প্রাইভেট টিউশন ও গাইড বইয়ের ব্যবহার বিষয়ে জানতে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানে জরিপ চালায় গণসাক্ষরতা অভিযান। এতে ৬০০ প্রতিষ্ঠানের তিন হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া গুণগত অনুসন্ধানের জন্য পাঁচটি উপজেলায় ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণীকক্ষ পর্যবেক্ষণ করা হয়। পাশাপাশি ১০ জন প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও ৩০ জন সহকারী শিক্ষকের বিস্তারিত সাক্ষাত্কার নেয়া হয়। জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতেসেকেন্ডারি স্কুল টিচারস ইন বাংলাদেশ: ইন দ্য লাইট অব এসডিজি ফোর শীর্ষক এডুকেশন ওয়াচ ২০১৮-১৯ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। গতকাল রাজধানীর এলজিইডি মিলনায়তনে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়।

এডুকেশন ওয়াচ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গণিত ও ইংরেজির পাশাপাশি মাধ্যমিকের অন্যান্য বিষয়েও অধিকাংশ শিক্ষকের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ নেই। বিশেষ করে বিজ্ঞান শাখার শিক্ষকদের বড় অংশই বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের বাইরে রয়ে গেছে। জীববিজ্ঞানের ৭০ শতাংশ, পদার্থবিজ্ঞানের ৭৫ দশমিক ৫ ও রসায়নের ৭৭ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষকই বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ পাননি। এছাড়া বাংলার ৬৭ শতাংশ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ৭৮, সাধারণ বিজ্ঞানের ৬৪ ও হিসাববিজ্ঞানের ৬৬ শতাংশ শিক্ষক বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ পাননি। মাধ্যমিকের ৩৪ শতাংশ শিক্ষকের বিএড, এমএড ও বিপিএডের মতো পেশাগত প্রশিক্ষণও নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে গণসাক্ষরতা অভিযানের ওই প্রতিবেদনে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এসএম হাফিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের তিনটি ভাগে ভাগ করি। খুব বেশি মনোযোগী, মধ্যম পর্যায়ের মনোযোগী ও খুব কম মনোযোগী। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী শিক্ষার্থীরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও আকর্ষণীয় বেতনের চাকরিগুলোয় যাচ্ছে। আর সবচেয়ে কম মনোযোগী শিক্ষার্থীরাই শিক্ষকতায় যাচ্ছে। এজন্য আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মাধ্যমিক শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের বিষয়টি খুবই জরুরি। মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, অনেক শিক্ষক ইংরেজি বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও এ বিষয়ে পাঠদান করছেন। বিজ্ঞান কিংবা গণিতের মৌলিক জ্ঞান ছাড়াই শিক্ষক ক্লাসরুমে পড়াচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কোনো জিজ্ঞাসা এলে নিজের মতো ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এর ফলে অনেক সময় দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা ভুল শিখছে। তাই বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয়টি আরো গুরুত্বসহকারে নেয়া উচিত।

গণসাক্ষরতা অভিযানের জরিপে অংশ নেয়া শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ২২ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষক এর সঙ্গে জড়িত থাকার কথা জানান। এডুকেশন ওয়াচ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে প্রাইভেট টিউশনের হার ১৭ দশমিক ২ শতাংশ ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এ হার ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এছাড়া এলাকার দিক থেকে শহর অঞ্চলের শিক্ষকদের মধ্যে প্রাইভেট টিউশনের হার বেশি। শহর অঞ্চলের ৩০ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষক প্রাইভেট টিউশনের সঙ্গে জড়িত, যেখানে গ্রামাঞ্চলে এ হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। বিষয়ভিত্তিক দিক থেকে গণিতের শিক্ষকরা প্রাইভেট টিউশনে সবচেয়ে বেশি জড়িত। গণিতের প্রায় ৫১ শতাংশ শিক্ষকই প্রাইভেট টিউশন করান। ইংরেজি, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞানের শিক্ষকদের মধ্যে এ হার যথাক্রমে ৩৭ দশমিক ৫, ২৮ দশমিক ৩ ও ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রাইভেট টিউশনের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ শিক্ষকই নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পড়ান।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখানে আপনি দেখেন একজন শিক্ষক প্রাইভেট টিউশন করাচ্ছেন, সেটি আবার নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের। এটি অনেক ভয়াবহ তথ্য। অথচ এ শিক্ষকের কথা ছিল শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে পড়ানো।

শিক্ষকদের আত্মমূল্যায়নের ভিত্তিতে দক্ষতা সূচক নির্ণয় করা হয়েছে এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্টে। সেখানে দেখা যায়, নিজেকে উচ্চপর্যায়ের দক্ষ মনে করেন শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষক। অদক্ষ মনে করেন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষক। এছাড়া ১৫ শতাংশ শিক্ষক নিজেকে দক্ষ, ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ পরিমিত দক্ষ ও ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষক গড়পড়তা দক্ষ ও ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষক নিজেদের সীমিত পরিমাণে দক্ষ মনে করেন।

বিষয়ভিত্তিক পাঠদানের ক্ষেত্রে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে গণসাক্ষরতা অভিযান। সেখানে দেখা যায়, বেশির ভাগ শিক্ষকই পাঠদানের ক্ষেত্রে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করছেন না। সবচেয়ে বেশি মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করেন হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষকরা, সেটিও মাত্র ৩০ শতাংশ। মাল্টিমিডিয়া সবচেয়ে কম ব্যবহার করেন চারু ও কারুকলার শিক্ষকরা। মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ চারু ও কারুকলার শিক্ষক মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করেন। এছাড়া ইংরেজি বিষয়ে ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ, জীববিজ্ঞানের ২৩ দশমিক ৯ ও পদার্থবিজ্ঞানের ২০ শতাংশ শিক্ষক পাঠদানের ক্ষেত্রে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করেন।

মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিক্ষকরা বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট, প্রশিক্ষণের অভাব, শ্রেণীকক্ষের অপ্রতুলতা, পর্যাপ্ত সরঞ্জামের অভাব, দক্ষতার অভাব, ত্রুটিপূর্ণ সরঞ্জাম, প্রস্তুতিমূলক সময়ের অভাব ও অকার্যকরী উপকরণ।

শিক্ষকদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ শিক্ষাক্রম, শিক্ষানীতি ও এসডিজির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জানেন না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জরিপে অংশ নেয়া শিক্ষকদের ৬৩ শতাংশ শিক্ষানীতি পড়েছে, শিক্ষাক্রম পড়েছে ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশ শিক্ষক এসডিজি বিষয়ে শুনেছেন বলে জানান।

সার্বিক বিষয়ে উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, সরকার এতদিন শিক্ষা ব্যবস্থার হার্ডওয়্যার তথা অবকাঠামো উন্নয়নে মনোযোগী ছিল। এ খাতে বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে সে বিনিয়োগ চলে যাবে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর খাতে। এর অংশ হিসেবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে। আসলে শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি সব অংশীজনকে এগিয়ে আসতে হবে। অভিভাবকদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। প্রাইভেট টিউশন কিংবা গাইড বইয়ের যে বাণিজ্য, সেখানে ব্যবসায়ী ও ভোক্তা দুটি শ্রেণীই রয়েছে। অভিভাবকদের মধ্যেও কোচিং ও গাইড বইয়ের মাধ্যমে সন্তানের জন্য বাড়তি কিছু পাওয়ার এক ধরনের প্রবণতা রয়েছে। এ ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন