সামনের মাসে উৎপাদনে আসছে জিপিএইচ ইস্পাতের নতুন কারখানা

তিন বছরে রাজস্ব বাড়বে ৫ হাজার কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অত্যাধুনিক কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তির নতুন স্টিল উৎপাদন কারখানা স্থাপন করছে জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড। এরই মধ্যে কারখানার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কারখানাটিতে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হবে। আর আগামী মাসের শেষের দিকেই বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। চালুর পর তিন বছরের মধ্যেই নতুন এ কারখানা থেকে বছরে ৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আসবে বলে জানিয়েছেন কোম্পানিটির কর্মকর্তারা।

সম্প্রতি জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, ৬০ একর জায়গার ওপর বিশাল কারখানা স্থাপনের কর্মযজ্ঞ চলছে। এরই মধ্যে আনুষঙ্গিক স্থাপনাসহ সব ধরনের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে। চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। এ কারখানায় প্রায় ২০০ জন দেশী-বিদেশী প্রকৌশলী কাজ করছেন। স্টিলের প্রধান কাঁচামাল বিলেট উৎপাদনের জন্য কোস্পানির একটি বিশাল স্ক্র্যাপ ইয়ার্ড রয়েছে, যার সক্ষমতা তিন লাখ টন। ২ ঘণ্টার মধ্যে স্ক্র্যাপ থেকে এ কারখানায় রড উৎপাদন করা হবে।

জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানায় ব্যবহূত কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস সরবরাহ প্রযুক্তি সরবরাহ করছে অস্ট্রিয়ার প্রাইমেটাল টেকনোলজিস, যা জার্মানির সিমেন্স ও জাপানের মিত্সুবশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজের যৌথ মালিকানাধীন একটি কোম্পানি। এ প্রযুক্তির প্রথম কারখানাটি স্থাপিত হয়েছে উত্তর আমেরিকার দেশ মেক্সিকোয়। জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানাটি বিশ্বে কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তির দ্বিতীয় কারখানা। তাছাড়া জিপিএইচ ইস্পাতের নতুন কারখানায় উইনলিংক নামের একটি প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে যেকোনো দৈর্ঘ্যের পণ্য উৎপাদন করা যায়। এ প্রযুক্তির প্রথম কারখানাটি স্থাপিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা রাজ্যে।

জিপিএইচ ইস্পাতের মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প) . সাইদ সুমন নতুন কারখানা সম্পর্কে বলেন, আমাদের কারখানায় বিশ্বের সর্বাধুনিক ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এ প্রযুক্তিতে নির্মিত ইস্পাত কারখানা জ্বালানি সাশ্রয়ী। প্রচলিত পদ্ধতির ইস্পাত কারখানায় ইস্পাত চুল্লিতে স্ক্র্যাপ বা পরিত্যক্ত লোহা গলানোর পর ৬ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত খাদ থাকে। কিন্তু জিপিএইচে ব্যবহূত কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তিতে খাদ থাকবে ১ শতাংশের কম। অন্যদিকে এ প্রযুক্তির চুল্লিতে লোহা গলিয়ে ইস্পাত উৎপাদনকালে কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সঠিক মাত্রায় বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান মেশানো হবে।

নতুন কারখানাটি চালু হলে জিপিএইচের রড উৎপাদনক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১০ লাখ টনে। বর্তমানে কোম্পানিটির উৎপাদনক্ষমতা ১ লাখ ৬৪ হাজার টন। নতুন কারখানায় ৫০০ ডব্লিউ টিএমটিবার ও বিভিন্ন গ্রেডের রডের পাশাপাশি সেকশন, অ্যাঙ্গেল, চ্যানেল, এইচ বিম, আই বিমসহ নানা ধরনের পণ্য উৎপাদিত হবে। উৎপাদিত হবে প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিং নির্মাণের নানা উপকরণ। নতুন প্ল্যান্টে বছরে ৮ লাখ ৪০ হাজার টন এমএস বিলেট উৎপাদন হবে। রি-বার ও সেকশন উৎপাদিত হবে ৬ লাখ ৪০ হাজার টন।

জিপিএইচ ইস্পাতের নির্বাহী পরিচালক (অর্থ ও ব্যবসা উন্নয়ন) কামরুল ইসলাম জানান, নতুন কারখানা স্থাপনে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ ইকুইটি ও ৭০ শতাংশ ঋণ। ইকুইটির কিছু অংশ রাইট শেয়ারের মাধ্যমে আর বাকি অর্থ কোম্পানির নিজস্ব তহবিল থেকে এসেছে। এর বাইরে বিশ্বব্যাংক ও জার্মানির ব্যাংকের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাকি ৭০ ভাগ অর্থের জোগান দিয়েছে। বর্তমানে জিপিএইচ গ্রুপের সমন্বিত বার্ষিক টার্নওভার ৮ হাজার কোট টাকা। নতুন কারখানাটি চালু হওয়ার তিন বছরের মধ্যেই আরো ৫ হাজার কোটি টাকার টার্নওভার যোগ হবে বলে জানান তিনি।

অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে জিপিএইচ ইস্পাতের নতুন কারখানা থেকে প্রতি হাজার ঘনফুট বাতাসে সর্বোচ্চ ১০ মাইক্রোগ্রাম কার্বন নিঃসরণ হবে। বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ড অনুযায়ী ৫০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ গ্রহণযোগ্য। এ কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় পানির ৩০ ভাগ ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে নেয়া হবে। বাকি ৭০ ভাগ পানি আসবে জমিয়ে রাখা বৃষ্টির পানি থেকে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য কারখানায় একটি জলাধার নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি কারখানায় ব্যবহূত পানি পরিশোধনের মাধ্যমে বারবার ব্যবহারের ফলে এ কারখানা থেকে কোনো তরল বর্জ্য নির্গত হবে না।

জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলমাস শিমুল বলেন, আমরা শুধু নিজেদের ব্যবসা কথা চিন্তা করে এ কারখানা স্থাপন করিনি। দেশের অর্থনীতি ও শিল্পায়নে যাতে অবদান রাখতে পারি, সেটিই ছিল আমাদের লক্ষ্য। তাছাড়া এর মাধ্যমে আমরা অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছি। আমাদের বিদ্যমান কারখানায় ১ হাজার ৪০০ জনের প্রত্যক্ষ এবং আরো প্রায় ২ হাজার ৫০০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর নতুন কারখানায় সরাসরি ২ হাজার ৫০০ এবং পরোক্ষভাবে আরো আট হাজার জনের কর্মসংস্থান হবে বলে জানান তিনি।

একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে আজকের অবস্থানে আসার কথা উল্লেখ করে জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের এ কারখানার মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং হবে। আমরা কেবল শিল্পায়নের যুগে প্রবেশ করেছি মাত্র। উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত হতে আরো অনেক বেশি শিল্পায়ন করতে হবে। আর শিল্পায়নের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হচ্ছে রড ও সিমেন্ট।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন