এমএফএস খাতে এমএনওদের মালিকানা প্রশ্ন

খন্দকার সাখাওয়াত আলী

বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) গাইডলাইন প্রথম নিয়ে আসে ২০১১ সালে। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে সরকার গঠনের পর ডিজিটালাইজেশনের ওপর প্রাধান্য দেয়। এমএফএস নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে, কিন্তু বাস্তবে এগোনোর মতো কোনো প্রস্তুতি নেয়া হয়নি।  কাজেই ডিজিটালাইজেশনের উদ্দেশ্য ও কৌশল সামনে রেখে ২০১০ সালটা ছিল এমএফএস খাতের সত্যিকার প্রস্তুতি পর্ব। ২০১১ সালের বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইনের ওপর ভিত্তি করে গত প্রায় এক দশকে এমএফএস বড় আকারে এ খাতের ওপর সামাজিক নির্ভরশীলতা ও সার্বক্ষণিক অর্থনৈতিক লেনদেনের নেটওয়ার্কের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমএফএসের দেশজুড়ে এমন বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়ার কথা সংশ্লিষ্ট রেগুলেটররাও শুরুতে ভাবতে পারেনি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর মোবাইল টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে প্রাধান্য দেয়। আর ২০০৮ সালে দ্বিতীয় দফা সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ ধারাবাহিকভাবে সেলফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসার ঘটানোর কৌশল নেয় এবং সফল হয়। ফলে প্রযুক্তিভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস দেশে চালু হয়েছে। দেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে যে বিপুল জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের এমএফএসের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি খাতের এ সাফল্য এ সরকারের একটি বড় সাফল্য। দেশে চার-পাঁচটি এমএফএস অপারেটরের কাজ কম-বেশি আজ দৃশ্যমান। বিশেষ করে এগুলোর মধ্যেবিকাশ তার উদ্ভাবনী উদ্যোগের জন্য দেশী ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেমন স্বীকৃতি পেয়েছে, একই সঙ্গে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এর সেবা পৌঁছে গেছে।

এমএফএসের এই দ্রুত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তাই এমএফএস খাতের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রশ্নটি দেশ ও জনস্বার্থে বিশেষ জরুরি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তীতে দ্বিতীয় রেগুলেশন নিয়ে আসে ২০১৮ সালে। দ্বিতীয় প্রজন্মের রেগুলেশনের মাধ্যমে এ খাতের সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ ব্যাংকের এমএফএস অনুমোদিত রেগুলেশনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মোবাইল অপারেটরগুলোর এমএফএস খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্যারেন্ট প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেয়। এ প্রবন্ধে আমরা এমএফএস রেগুলেশনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এমএনও মালিকানা অনুমোদন কার স্বার্থে, সে বিষয়টি আলোচনায় তুলে ধরার চেষ্টা করব।


এমএনওর মালিকানার সুযোগ নেই

এমএফএস রেগুলেশন (২০১৮) অনুসারে, বাংলাদেশ ব্যাংকের এমএনওগুলোকে এমএফএস লাইসেন্স অনুমোদনের সুযোগ নেই। এই না পারার কারণগুলো সময়ানুসারে নিচে তুলে ধরা হলো

প্রথমত, এমএনওরা এমএফএস লাইসেন্স গোড়া থেকেই চেয়ে আসছে। দীর্ঘ প্রায় এক দশক ধরে অপ্রকাশ্য ও প্রকাশ্য নানাভাবে দেশী ও বিদেশী শক্তি এমএনওর পক্ষে লবিস্ট হয়ে কাজ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এ মালিকানা না দেয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে মূলত দুটি বড় যুক্তি ছিল। এক. এমএফএস খাতটি ব্যাংক লেড মডেল হতে হবে। দুই. পাইপলাইন বনাম কনটেইন, অর্থা ইউটিলিটি সার্ভিসসংক্রান্ত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান (যেমন এমএফএস, ব্যাংক, ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি, বীমা সংস্থা) কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন শিল্প-কারখানা, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মিডিয়া করার সুযোগ নেই। কারণ ইউটিলিটি প্রতিষ্ঠান তাদের সেবা প্রদানের জন্য (সেশনভিত্তিক) সুনির্দিষ্ট হারে রেভিনিউ পায়। কাজেই সেলফোন কোম্পানিগুলোকে যদি সেবাভিত্তিক অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ দেয়া হয়, তবে একক শক্তির হাতে পুঁজির কেন্দ্রীভবনের সম্ভাবনা থাকে এবং একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সেলফোন কোম্পানিগুলোর কাছে চলে যাবে।

এমএফএস খাতের এ প্রতিযোগিতাবিরোধী চ্যালেঞ্জগুলোবাংলাদেশের মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের সাফল্য সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ গ্রন্থে (২০১৭) আমি এরই মধ্যে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছি। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে আমার মূল পর্যবেক্ষণ ও ইস্যুগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে নিচে তুলে ধরছি

. এমএফএসের সব গ্রাহক কোনো না কোনো এমএনওর অংশীজন এবং স্বাভাবিকভাবে এমএনওর নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই এমএনওকে যদি এমএফএস করার সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে এমএনওর মালিকানাধীন এমএফএসের গ্রাহকদের সঙ্গে অন্য এমএফএসের গ্রাহকদের অনিবার্যভাবেই একটি অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। এটা হবে বাজারের সাধারণ নিয়ম বিবেচনায় অনেকটা অনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং যা রীতিমতো গ্রাহক স্বার্থ ও অধিকারবিরোধী।

. এমএনও এমএফএসের ব্যবসার ভেতরে প্রবেশ করতে চায় শুধু মুনাফার জন্য এমনটা নয়। বরং তাদের মূল লক্ষ্য এমএফএস ব্যবসাটির ওপর নিয়ন্ত্রণ নেয়া। আগেই বলেছি, অর্থনৈতিক বিচারে এমএফএসের ব্যবসা এমএনওর সামগ্রিক ব্যবসার খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ হতে পারে। এমএনওগুলোর এমএফএস খাতে প্রবেশের একটি পদ্ধতি হতে পারে ডাম্পিং কৌশল অবলম্বন। অর্থা এমএনও মালিকানাধীন এমএফএসের জন্য নির্ধারিত মানের বাজারমূল্য থেকে কম দামে কথা বলার সেবা দেয়া, যাতে অন্যান্য এমএফএস ব্যবসায় সফলতা হারায় এবং ভবিষ্যতে এ ইন্ডাস্ট্রিতে আর টিকে থাকতে না পারে। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অবশ্যই হস্তক্ষেপ করতে হবে এবং তা অবশ্যই করতে হবে গ্রাহক স্বার্থ বিবেচনায় রেখে।

. কৌশল হিসেবে এমএনও কিছু সময়ের জন্য এমএফএসকে এমনভাবে সাজানোর চেষ্টা করছে, যাতে এ খাতে অন্যরা বিনিয়োগ করতে অনুসাহিত হয়। যেমন তারা এখন পর্যন্ত একাধিক এমএফএস প্রতিষ্ঠানকে ন্যায্যমূল্যে নেটওয়ার্কের সংযোগ দেয়নি, যা এ ইন্ডাস্ট্রির সঠিক প্রতিযোগিতার বিষয়টি নষ্ট করে। ফলে এমএফএসের আগ্রহী অনেক ব্যাংক বড় ধরনের পুঁজি বিনিয়োগ করাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে। এমএনওরা প্রাথমিকভাবে কৌশল হিসেবে এ খাতের প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টিতে বাধা তৈরিতে সফল হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, এমএফএস রেগুলেশন (২০১৮) অনুসারে, এমএফএস প্রোভাইডারদের মডেলের [ধারা ৬-এর (ii), (a), (b)] কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলা হয়েছে, এ ধারা অনুসারে উদ্যোক্তা ব্যাংক (Parent bank) এককভাবে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি অথবা ইকুইটি পার্টনার নিয়ে নিম্নোক্ত ব্যবসায়িক আইনি ভিত্তি হতে পারবে

. ব্যাংক (সমূহ), নন-ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান (সমূহ);

. এনজিও, বিনিয়োগকারী, ফিনটেক প্রতিষ্ঠান (সমূহ), যাদের ফিন্যান্সিয়াল মার্কেটে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে; শুধু এমএনও ছাড়া। অর্থাৎ এমএনও ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত সব পক্ষ (এমএনও অপারেটর ও বেনিফিশিয়ারি ওনারশিপ, অর্থা প্যারেন্ট প্রতিষ্ঠান বা বিনিয়োগকারী)


উপরোক্ত তথ্যভিত্তিক আলোচনার ভিত্তিতে এমএফএস রেগুলেশনের ব্যাপারে তিনটি পর্যবেক্ষণ নিচে তুলে ধরা হলো:

প্রথমত: এমএফএস গাইডলাইন (২০১১) আসার পর থেকে শত চেষ্টা করে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃঢ অবস্থানের কারণে এমএনওরা এমএফএস লাইসেন্স পাইনি। বরং লাইসেন্স পাওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তারা ইউএসএসডির দাম বাড়ানোর কৌশল নেয় এবং সফল হয়। উল্লেখ্য, প্রতি সেশনের প্রকৃত খরচ শূন্য দশমিক ২৯ পয়সা১০ করে হিসাব করা হলেও পরিবর্তে শূন্য দশমিক ৮৫ পয়সা করে দাম স্থির হয় এবং এ হারেই বর্তমানে এমএফএস অপারেটরদের কাছ থেকে রেভিনিউ আদায় করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিটিআরসি যৌথইউএসএসডি টেকনিক্যাল কমিটির অভিজ্ঞতা থেকে আমার নিজের জানা, মোবাইল টেলিফোন কোম্পানিগুলোর সংস্থা এমটবের পক্ষ থেকে প্রতি সেশন খরচ হিসেবে ৩ দশমিক ৫০ টাকা প্রস্তাব করেছিল।১১ পরবর্তীতে দীর্ঘ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সে দাম কমিয়ে শূন্য দশমিক ৮৫ পয়সায় রাজি হয়। 

দ্বিতীয়ত, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক এমএফএস রেগুলেশনের ড্রাফট এ খাতের সঙ্গে যুক্ত সব স্টেকহোল্ডার এবং সাধারণের মতামত ও আলোচনার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। ড্রাফট রেগুলেশনে এমএনওকে ১৫ শতাংশ করে মোট ৩০ শতাংশ মালিকানার সুযোগ দুটি এমএনওর জন্য রাখা হয়েছিল।

বাংলাদেশে এমএফএস সেবার বয়স প্রায় এক দশক হতে চলল। এই এক দশকে এরই মধ্যে দু-দুবার (২০১১ ও ২০১৮ সালে) এমএফএস রেগুলেশন পরিবর্তন করেছে। এ দুই রেগুলেশনেই এমএফএস মালিকানার প্রশ্নে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরগুলোর মালিকানা রাখার সুযোগ দেয়া হয়নি সুনির্দিষ্ট ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে। কারণ সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। 

২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল অব্দি দীর্ঘ তিন বছর ধরে এমএফএস খাতে এমএনওদের মালিকানা নিয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে নানা আলোচনা চলে। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা থেকে স্থির হয়, এমএফএস খাতের মালিকানা এমএনওকে দেয়া হবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে চূড়ান্তভাবে আলোচনা হয় দুই স্তরে। প্রথমত, বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ডে আলোচনার ভিত্তিতে দুজন বোর্ড সদস্য নিয়ে একটি কমিটি করে দেয়া হয়; যা এমএফএস খাতের সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে আলোচনা করে, সব স্টেকহোল্ডারের আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয় যেমোবাইল নেটওয়ার্ক প্রোভাইডার কর্তৃক এমএফএস সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে অংশীদারিত্বের কোনো সুযোগ নেই।’ [(সংশোধিত রেগুলেশনসে সেকশন ৬.১ (ii) (b)]-এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

তৃতীয়ত, এমএনওদের বিনিয়োগকারীদের এমএফএসদের কার্যক্রম পরিচালনার অনাপত্তিপত্র প্রদানএমন সিদ্ধান্ত হঠা করে কেন এবং কার স্বার্থে? তবে আগের যুক্তি ও বাস্তবতা কি হঠা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন