চাই সমন্বিত উদ্যোগ

মোহাম্মদ আফতাবুজ্জামান

বাংলাদেশে শিশুশ্রম তুলনামূলকভাবে কমলেও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা কমেনি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষা-২০১৩ হতে আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশে সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ শিশু, যাদের কাজ শিশুশ্রমের আওতায় পড়েছে। বাকি শিশুদের কাজ অনুমোদনযোগ্য। কর্মরত শিশুদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে প্রায় ১২ লাখ ৮০ হাজার। আর ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। তাদের কাজের ধরন জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য বেশ হুমকিস্বরূপ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলেও শিশুশ্রমিকের সংখ্যা উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়ে গেছে। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে অল্প বয়সী এসব শিশু অমানবিক পরিশ্রম করছে। জাতীয় শিশুনীতিতে (২০১৩) এটা স্বীকার করা হয় যে, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে শিশুরা নানা শ্রমে নিয়োজিত হয়। এক্ষেত্রে গ্রাম-শহরের ভেদ নেই। কর্মরত শিশু, শিশুশ্রম, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের আলাদা সংজ্ঞা রয়েছে। ১৮তম শ্রম পরিসংখ্যানবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এবং ২০১৩-এর সংশোধন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, ১২-১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। এ শ্রম অনুমোদনযোগ্য। তবে ৫-১১ বছর বয়সী কোনো শিশু যদি কোনো ধরনের ঝুঁকিহীন কাজও করে, তবে সেটা শিশুশ্রম হবে। তারাও কর্মরত শিশুদের মধ্যে পড়ে যায়। আর পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে স্বীকৃত।

চরম দারিদ্র্যের কারণেই শিশুরা শ্রমে নিয়োজিত হতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে সরকারকে যেমন একদিকে শিশু অধিকার সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে, তেমনি দারিদ্র্য হ্রাসে আরো মনোযোগ দিতে হবে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের হিসাবমতে, দেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে ১৩ লাখ শিশু। সরকারের একার পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন করা সম্ভবপর নয়। এ কাজের জন্য চাই সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ

ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি শিশু বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। লেগুনার হেলপার, লেদ মেশিনের কাজ, ওয়েল্ডিং, গৃহশ্রমিক, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের ফলে বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে শিশুশ্রমিক নেই, কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে শিশুশ্রমিক আছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো শিশুরাই করে থাকে। শুধু তা-ই নয়, অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

শিশুশ্রমের কারণ খুুঁজতে গেলে দেখা যাবে যে, এটা একটা চক্র। আর এ চক্রের অনেক উপাদানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দারিদ্র্য, কাজের অভাব, মাইগ্রেশনএকাকী অথবা পরিবারের সঙ্গে, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা, কারিগরি শিক্ষার অভাব, স্কুল থেকে ঝরে পড়া, নিরাপত্তার অভাব, অভিভাবকের উদাসীনতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি।

দারিদ্র্য, কাজের অভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের (নদীভাঙন) শিকার হয়ে মানুষ শহরে আসে এবং জীবনধারণের জন্য যেকোনো কাজ করতে বাধ্য হয়। অভিভাবকরা অনেক সময় নিজেরা কাজ করে সংসার চালাতে না পেরে তাদের শিশুদেরও কাজে নিযুক্ত করে। না খেয়ে থাকার চেয়ে যেকোনো কাজ করে কিছু আয় করলে সংসার চালাতে সহজ হবে। এ শ্রেণীর পরিবার মনে করে, শিশু ঘরে বসে থাকলে অথবা শিশুকে স্কুলে পাঠালে আয় কম হবে। এ পরিবারগুলো অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে। শহরে আসার পর পরিবারের সবাইকে কাজ করতে হয়, পরিবারের শিশুটিও বাদ যায় না।

বিশেষ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যখন কোনো শিশু একাকী শহরে আসে, তখন তাকে জীবনধারণের জন্য কোনো না কোনো কাজ করতে হয়। শিশুটির মনে তখন একটাই ভাবনা, তাকে এ শহরে টিকে থাকতে হবে। প্রয়োজনের তাগিদে শিশুটি যেকোনো কাজ করতে রাজি থাকে। শিশুটির প্রয়োজনকে পুঁজি করে সুবিধাভোগীগোষ্ঠী শিশুটিকে ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজে নিয়োগ দেয়।

পড়াশোনায় অমনোযোগিতা ও স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুশ্রমের অন্যতম একটা কারণ। বাবা-মা চায় তার সন্তান পড়াশোনা করুক, কিন্তু শিশু ঠিকমতো স্কুলে যায় না, পড়াশোনা করে না। এসব কারণে অভিভাবক বিরক্ত হয়ে শিশুটিকে কোনো না কোনো কাজে নিযুক্ত করেন। অভিভাবক চিন্তা করেন, পড়াশোনা না করে বসে থাকলে মাদক নেবে, সন্ত্রাসী কোনো কর্মকাণ্ড করবে। এর চেয়ে ভালো কোনো কাজ করলে অন্তত শিশুটা এসব সমাজবিরোধী কাজ করবে না। শিশুর সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনা করে অভিভাবক তার শিশুসন্তানকে কাজে দিতে বাধ্য হয়।

অপ্রাতিষ্ঠানিক অনেক সেক্টরে বয়স্ক শ্রমিক/কর্মীর অভাবে শিশুদের নিয়োগ দেয়া হয়। ওয়েল্ডিং কারখানাগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, আর এ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োগ দেয়া হয়। ঢাকা শহরে যত লেগুনা আছে, প্রায় সব লেগুনার ড্রাইভার কিশোর বয়সের এবং লেগুনার হেলপার শিশু, যার বেশির ভাগেরই বয়স দশের মধ্যে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এ শিশুরা হয় দারিদ্র্য অথবা পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়ার কারণে এ পেশায় এসেছে।

বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে বর্তমানে শিশুশ্রমিক নেই বললেই চলে। কিন্তু এ অবস্থা ১০-১৫ বছর আগেও কল্পনা করা যেত না। প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্র থেকে শিশুশ্রম নিরসন সম্ভব হয়েছে সচেতনতা এবং সরকারি-বেসরকারি নজরদারির কারণে। কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে শিশুশ্রম বেড়েছে। এর কারণ শ্রমের সহজলভ্যতা। দরিদ্র পরিবারের অভিভাবক ও বিশেষ পরিস্থিতির শিকার অভিভাবক চান তাদের সন্তান কোনো না কোনো কাজ করুক। অন্যদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মালিক চান সস্তায় শ্রম কিনতে। এ দুই পক্ষের চাহিদা মিলে যাওয়ার ফলে তৈরি হয় শিশুশ্রম। শিশুশ্রমের ভয়াবহ রূপ হলো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ। পরিবহন খাত, ওয়েল্ডিং কারখানা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এসব ক্ষেত্রে যেসব শিশু কাজ করে, তারা সবাই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করে।

শহর অঞ্চলে শিশুশ্রম অথবা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম দেখা যায় গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে। গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিকদের বেশির ভাগের বয়স ১৪-এর নিচে এবং এ শ্রমিকদের মধ্যে মেয়েশিশুদের সংখ্যা বেশি। এ শিশুরা যাদের বাসায় কাজ করে, তারা সবাই উচ্চশিক্ষিত ও বিত্তবান। এ শিক্ষিত ও বিত্তবান শ্রেণী নিয়মিত শিশু অধিকার লঙ্ঘন করছে এবং গৃহে শিশুদের দিয়ে কাজ করাচ্ছে। এ শিশুদের আয় তাদের পরিবারে আর্থিক সহায়তা দেয়।

ঝুঁকিপূূর্ণ শিশুশ্রমের আরেকটি খাত হলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। শহরাঞ্চলে ময়লা-আবর্জনা থেকে পুনরায় ব্যবহার্য সামগ্রী সংগ্রহ এবং রাস্তায় ভাঙারি কুড়ানো কাজ শিশুরাই করে থাকে। শিশুরা কোনো না কোনো মালিকের অধীনে কাজ করে। মালিক তাকে আশ্রয় দেন, বিনিময়ে শিশুরা ভাঙারি কুড়িয়ে তাদের মালিককে দেয়। থাকার জন্য জায়গা পাওয়ার কারণে শিশুরা বছরের পর বছর ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে থাকে।

ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রাইমারি পর্যায়ে বিভিন্ন এলাকায় যে ময়লা সংগ্রহ করা হয়, তা সংগ্রহ করে কিশোর বয়সী শ্রেণী, যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। আবর্জনা ব্যবস্থাপনা সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না থাকলে যেকোনো সময় যে কেউ সংক্রামক যেকোনো ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শিশুশ্রমের বিভিন্ন সংখ্যা প্রদান করে। তবে সংখ্যা যেটাই হোক, অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে শিশুশ্রম এবং ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বেড়েছে, এটা আমাদের মানতেই হবে। প্রশ্ন হলো, শিশুশ্রম নিরসনের দায়িত্ব কে নেবেসরকার? এনজিও? নাকি সামাজিক সংগঠন? এটা বলা যায়, কারো একার পক্ষে কখনো শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ সম্ভব নয়। তাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে গেছে, যেকোনো দেশের কাছে বাংলাদেশের উন্নয়ন ঈর্ষণীয় হওয়া সত্ত্বেও শিশুশ্রম বাড়ছে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের জটিলতার কারণে শিশুশ্রম না কমে দিন দিন বাড়ছে।

আর্থসামাজিক জটিলতাগুলো এতটাই প্রকট যে, কারো একার পক্ষে বাংলাদেশ থেকে শিশুশ্রম নিরসন করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের উল্লিখিত জটিল সমস্যার সহজতর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। আর এর জন্য দরকার সরকারি-বেসরকারি এবং সামাজিক যৌথ উদ্যোগ। সঙ্গে দরকার ব্যাপক গণসচেতনতা। কয়েক বছরের প্রকল্প গ্রহণ করে কিংবা প্রকল্পভিত্তিক কাজ করে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ করা সম্ভব নয়। শিশুশ্রমের সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনেক হয়েছে, এখন দরকার এ সমস্যা দূর করার কার্যকরী উদ্যোগ। বর্তমানে অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে যে পরিমাণ শিশু শ্রমিক আছে, সেই হার কমিয়ে আনতে দরকার দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা। এছাড়া সরকারের যে সাত-আটটি মন্ত্রণালয় শিশুদের কার্যক্রম সম্পর্কিত, তাদের সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। শিশুদের জন্য আলাদা অধিদপ্তর ও বাজেট বৃদ্ধি সময়ের দাবি। আর শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের (৩৮টি) তালিকাটি যোজন-বিয়োজন করে হালনাগাদ করা দরকার। জোর করে কোনো ক্ষেত্র থেকে শিশুশ্রম দূর করা সম্ভব নয়, এটা করতে হলে আগে বিকল্প কোনো উপায় বের করতে হবে। এখানে বিকল্প উপায় বলতে শিশুটির পরিবারের আর্থিক সহায়তার কথা বলা হচ্ছে। ৯০ শতাংশ শিশুই আর্থিক কারণে শ্রমে নিযুক্ত হয়। বিকল্প কোনো উপায় না রেখে শিশুশ্রম দূর করতে চাইলে নতুন নুতন প্রকল্প আসবে, অথবা খাতা- কলমে শিশুশ্রম মুক্ত বাংলাদেশ হবে, কিন্তু বাস্তবে শিশুশ্রম দূর হবে না।

 

মোহাম্মদ আফতাবুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক

আপন ফাউন্ডেশন

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন