পোশাক রফতানির অর্থ দেশে আসছে না

কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ইপিবি ও এনবিআর নজরদারি বাড়াক

বাংলাদেশের রফতানির বড় অংশজুড়ে রয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প। মোট আয়ের ৮০ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, আয় আরো বড় হওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে সেটি যোগ হচ্ছে না দেশের অ্যাকাউন্টে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৈরি পোশাক রফতানি ও প্রত্যাবাসিত আয়ের মধ্যে ব্যবধান ক্রমে বড় হচ্ছে। সাধারণত ৫ শতাংশ পার্থক্যকে স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এটি বেড়ে ১৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা দুশ্চিন্তার কারণও বটে। রফতানির বিপরীতে যথাযথ অর্থ দেশে না আসার বিভিন্ন কারণের মধ্যে শর্ট শিপমেন্ট, লেট শিপমেন্ট, ডিসকাউন্ট উল্লেখযোগ্য। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ আবার অর্থ পাচারের কথাও বলছেন। কারণ যা-ই হোক না কেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন দেশের স্বার্থেই। একাধিক ব্যাংকের অদক্ষতার কারণে রফতানি অর্থ ঠিক সময় দেশে আসছে না। কিন্তু এলসি খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংক যে সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করে, সে অনুযায়ী সেবা দেয় না। আর এ সুযোগ নিচ্ছেন বিদেশী বায়াররা। তিনি বলেন, এলসি, চুক্তি, টিটি (টেলিফোন ট্রান্সফার) এবং ট্রান্সফার ড্রাফটের (টিডি) মাধ্যমে পণ্য রফতানি করা হয়। রফতানির ক্ষেত্রে অনেক সময় এলসি করা না-ও হলে পরোক্ষভাবে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক থাকে রফতানিকারকদের। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে রফতানি মূল্য দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে। কিন্তু দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করছে না। ফলে অনেক ক্রেতা ঠিকমতো অর্থ পরিশোধ করছেন না। এতে রফতানিকারকসহ দেশের অর্থনীতিতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এর সমাধান প্রয়োজন। ব্যাংকের অবহেলার পাশাপাশি রয়েছে অসংখ্য বিদেশী ক্রেতার কারসাজি। তারা দেশের পণ্য ক্রয় করে ঠিকমতো পাওনা পরিশোধ করছেন না। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কালক্ষেপণ করছেন। এতেও রফতানির অর্থ দেশে কম আসছে। ফলে হাজার হাজার কোটি টাকা বছরের পর বছর ধরে দেশের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

রফতানি মূল্য যথাসময়ে না আসার জন্য দায়ী ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সমন্বয়কারী মধ্যস্বত্বভোগীরা। কারণ তারা বায়ার থেকে কমিশন গ্রহণ করেন আর সেলারদের থেকেও কমিশন নেন। কোনো পক্ষ যদি তাদের চাহিদা অনুযায়ী কমিশন প্রদানে ব্যর্থ হয়, তাহলে দুই পক্ষেরই লেনদেন করতে সমস্যা দেখা দেয়। তবে বেশি সমস্যায় পড়েন দেশের রফতানিকারকরা। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, বায়ারদের প্রতিনিধিরা (মধ্যস্বত্বভোগী) রফতানিকারকদের থেকে চাহিদা অনুযায়ী কমিশন না পেলে তারা রফতানীকৃত পণ্যের বিভিন্ন দোষ তুলে ধরেন বায়ারদের কাছে। এর ফলে অনেক সময় পণ্যের উপযুক্ত মূল্য পাওয়া যায় না। পাশাপাশি পণ্যের মূল্য নির্দিষ্ট সময়ে দেশে আসে না। আবার অনেক সময় পণ্যের কোনো মূল্যই দেয়া হয় না রফতানিকারকদের। এজন্য সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিত। আশির দশক থেকে রফতানি মূল্যের একটি অংশ দেশে আসছে না। এর সঙ্গে বর্তমানে বড় অংক যোগ হয়েছে। রফতানির অর্থ নির্দিষ্ট সময় আনার ক্ষেত্রে রফতানিকারক, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এবং সরকারকে আরো জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিদেশী সংস্থা দেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশ করে। রফতানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা, তা বিশেষভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমদানির বিল পরিশোধ ও রফতানির বিল দেশে আনছে কিনা, তা তদারকি করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১১ সালে ড্যাস বোর্ড চালু করে। ওই সময় থেকে অনলাইনে রফতানি তথ্য সংগ্রহ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল রফতানির অর্থ যথাসময়ে ফেরত নিয়ে আসা। এক্ষেত্রে তাদের জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় কনজাম্পশন, ইনভেস্টমেন্ট, এক্সপোর্ট, ইমপোর্ট বিবেচনায় নেয়া হয়; সেখানে এ পার্থক্যের বিষয়গুলো সমন্বয় করা হতে পারে। এ পার্থক্য শুধু রফতানিতে নয়, রাজস্ব আহরণের তথ্যেও থাকে। ধারাবাহিকভাবেই এ পার্থক্য থাকে। আমাদের পরিসংখ্যানে সমস্যা তো আছেই। নিঃসন্দেহে পরিসংখ্যানগত এ সীমাবদ্ধতা সংশোধন হওয়া উচিত। পণ্য জাহাজীকরণ ও অর্থপ্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান হতে পারে, তবে তা এত বেশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। যেকোনো পণ্য রফতানি হওয়ার পর নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে অর্থ আসছে কিনা, তা নিশ্চিত করার জন্য রফতানিগুলো ট্র্যাক করা প্রয়োজন। নয় অর্থবছরের মোট পার্থক্য অনেক, এজন্যই এর যথাযথ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। প্রত্যেকটি ব্যাংককে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা উচিত।

রফতানির অর্থ নির্দিষ্ট সময় দেশে না আসা অপরাধ। এটি সময়মতো দেশে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সব তফসিলি ব্যাংককে রফতানির অর্থ নির্দিষ্ট সময় নিয়ে আসার জন্য তাগিদ দিতে হবে, যাতে কোনো বকেয়া না থাকে। পণ্য বিক্রি করে যদি টাকা না আসে, তাহলে অনেক ক্ষতি। ফলে ডলার সংকট দেখা দেয়াসহ বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। রফতানি মূল্য যদি ব্যাংকিং চ্যানেলে না আসে, তাহলে এতে অর্থ পাচারের ঘটনাও ঘটতে পারে। এ বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরো কঠোর তদারকি করা উচিত। ইপিবি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের দেখা উচিত তারা রফতানির পরিমাণ কতটা পাচ্ছে। কম বা বেশির বিষয়গুলো শনাক্তের পর কারণগুলো পর্যালোচনা করতে হবে। রফতানি ও অর্থপ্রাপ্তির পার্থক্য কমিয়ে আনার জন্য এ তিন সংস্থার সমন্বিত প্রয়াস জরুরি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন