‘ওরাকল অব ওহামা’খ্যাত ওয়ারেন বাফেট বেশির ভাগ সময় তার অর্থ শেয়ার বা ইকুইটি কেনা কিংবা অধিগ্রহণের পেছনে ব্যয় করাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে ঘটে সম্পূর্ণ উল্টো একটি ঘটনা। জুনের শেষ দিকে বিনিয়োগ পোর্টফোলিওর প্রায় ৬০ শতাংশ অর্থ বাজার থেকে তুলে নেয় বাফেটের প্রতিষ্ঠান বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে। বাফেট যেহেতু হাতে অর্থ রাখার মানুষ না, তাই বাজার থেকে প্রায় ১২ হাজার ২০০ কোটি ডলার তুলে নেয়ার এ ঘটনাকে শেয়ারবাজারে আসন্ন ধসের ইঙ্গিত হিসেবেই মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
২০০৮ সালে শেয়ারবাজার ধসের আগে বিপুল অর্থ মজুদ করে
সফলভাবে ধস মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন বাফেট। পরবর্তী সময়ে এ অর্থ থেকে হিমশিম
খেতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেন তিনি। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছিল গোল্ডম্যান স্যাকস
বা জেনারেল ইলেকট্রিকের মতো বড় প্রতিষ্ঠানও।
বিনিয়োগ-গুরু
ওয়ারেন বাফেট শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশকিছু নীতি অনুসরণ করেন। এসব নীতির
জন্যই মূলত সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সমাদৃত তিনি। বাফেটের বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে করপোরেশন
বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি। কোনো দেশের শেয়ারবাজার পরিস্থিতি
বোঝার জন্য রয়েছে বাফেট ইন্ডিকেটর। এ ইন্ডিকেটরের মাধ্যমে একজন বিনিয়োগকারী বুঝতে পারেন, কোনো
একটি দেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত নাকি উচিত নয়।
বাফেট ইন্ডিকেটর হলো, কোনো
দেশের শেয়ারবাজারের বাজার মূলধন ও দেশটির সামগ্রিক জিডিপির রেশিও। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি হলো, কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমায় একটি দেশের উৎপাদিত পণ্য ও সেবার মোট বাজারমূল্য। রেশিও খুব কম হলে
ধারণা করা হয়, বাজারে
উত্থান হবে এবং রেশিও খুব বেশি হলে বাজারে পতন হবে বলে ধরে নেয়া হয়। যদি একটি দেশের
শেয়ারবাজার সে দেশের জিডিপির ৫০ শতাংশ হয়,
তাহলে এ রেশিওকে অতি কম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদি
শেয়ারবাজার জিডিপির ৭৫ থেকে ৯০ শতাংশ হয়,
তাহলে একে সঠিক অবস্থা বলে বিবেচনা করা হয়। শেয়ারবাজারের
বাজার মূলধন জিডিপির ১১৫ শতাংশের বেশি হলে আপেক্ষিকভাবে একে অতিমূল্যায়িত বাজার হিসেবে
বিবেচনা করা হয়। এ ধরনের বাজারে পতনের আশঙ্কা থাকে সবচেয়ে বেশি।
ডটকম বাবলের উত্থানের ঠিক আগে বাফেট ইন্ডিকেটর ১৪৬
শতাংশে পৌঁছেছিল। ২০০৭ সালের আর্থিক সংকটের আগে বাফেট ইন্ডিকেটর দাঁড়িয়েছিল ১৩৫ শতাংশে।
বর্তমানে এ ইন্ডিকেটরটি ১৪০ শতাংশের উপরে রয়েছে। বাফেটের বিনিয়োগ থেকে সরে আসা এবং
উচ্চ বাফেট ইন্ডিকেটরের কারণে অনেক বিশেষজ্ঞই শেয়ারবাজারে ধসের আশঙ্কা করছেন।
৮৮ বছর বয়সী ওয়ারেন বাফেটকে বিনিয়োগ-গুরু হিসেবে বিবেচনা করা হলেও
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখনো তাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা যায় কিনা, এ নিয়ে
সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকে। পাঁচ বছর ধরে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের দুর্বল রিটার্নের
কারণে ডাও, নাসডাক
ও এসঅ্যান্ডপি ৫০০-এর মতো সূচকগুলো খুব ধীরগতিতে এগিয়েছে। আর এ কারণেই বাফেটের বিবেচনা
নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
বাফেটের বিবেচনা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলেও শেয়ারবাজারে
যে মন্দা চলমান, সে
বিষয়ে প্রায় সবাই একমত। বাফেট ইন্ডিকেটরের বাইরের বেশকিছু ফ্যাক্টর থেকেও এ ধরনের পরিস্থিতি
অনুমান করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ এরই মধ্যে সুদহার কমিয়ে এনেছে। মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সর্বশেষ দুই বৈঠকে সুদহার কমিয়েছে এবং পরবর্তী বৈঠকে সুদহার আরো কমানো হবে বলে অনেকে আশা করছেন। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, আগামী তিন মাস তাদের সুদহার কমানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। যদি ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকে পুনরায় সুদহার কমানোর ঘোষণা না দেয়া হয়, তবে বাজার পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে বলে অনুমান করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এছাড়া চীন ও ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুুদ্ধের
প্রভাবও পড়েছে শেয়ারবাজারের ওপর। চীন ও ইউরোপের নানা বক্তব্যের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে
শেয়ারবাজারে। কোনো পক্ষই সমাধানের পথে এগিয়ে না আসায় এটি অর্থনীতি এবং একই সঙ্গে শেয়ারবাজারকে
দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
এসঅ্যান্ডপি সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, তাদের
মূল্য আয় অনুপাত (পিই
রেশিও) ২১
দশমিক ৩। অন্যদিকে নাসডাক ঘোষণা দিয়েছে,
তাদের মূল্য আয় অনুপাত ৩০ দশমিক ৩৩। এ ধরনের ভ্যালুয়েশন
অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু এটিও মাথায় রাখতে হবে যে একটি অর্থনৈতিক শ্লথগতি এ সূচকগুলোকে
ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। একই সঙ্গে শেয়ারবাজারেও দেখা দিতে পারে আকস্মিক পতন।
বাফেট ইন্ডিকেটরের ভিত্তিতে শেয়ারবাজারে পতনের আশঙ্কা
নিয়ে সমালোচনা করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তারা বলছেন, বাফেট ইন্ডিকেটরের ভিত্তিতে শেয়ারবাজারে ধোঁয়াশা
তৈরি করা হচ্ছে। তাদের মতে,
ওয়ারেন বাফেট বাজার থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছেন, তার মানে
এই নয়, বাফেট
বাজারধসের আশঙ্কায় এটি করছেন। বাফেট হয়তো নতুন কোনো ডিলের অপেক্ষায় রয়েছেন। আর এর জন্যই
বাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করেছেন তিনি। তার অর্থ তুলে নেয়ার সঙ্গে ধসের কোনো সম্পর্ক
নেই।
বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে যেহেতু আর কখনো এত বেশি পরিমাণ
অর্থ মজুদ করেনি, এ
থেকে অনুমান করছেন, বাজার
পরিস্থিতি নিয়ে বাফেট উদ্বিগ্ন। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, উদ্বিগ্ন
হওয়ার মানে এই নয় যে বাফেট শেয়ারবাজার ধসের আশঙ্কা করছেন। বিনিয়োগ বাজারে বাফেট খুবই
গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। নিশ্চয়ই তিনি কোনো নতুন ডিলের অপেক্ষায় আছেন। সুতরাং ধস নয়, বরং নতুন
সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন বিনিয়োগ-গুরু
ওয়ারেন বাফেট।
সিসিএন,
বিজনেস ইনসাইডার ও দ্য উইনিং জোন অবলম্বনে
মেহেদী হাসান সবুজ