কয়েক দিন ধরে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের কোটি কোটি টাকার গল্প শোনা যাচ্ছে। পত্রিকায় কিছু আসছে, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে তার চেয়ে বেশি। বলা যায়, সরকারসংশ্লিষ্ট দলনেতাদের এক-দুটি আঙুল বিপদে। সরকার এর মধ্য থেকে কৃতিত্ব নেয়ার চেষ্টা করছে যে এটি তার দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ। দুর্নীতির প্রতি সরকারের জিরো টলারেন্সের প্রকাশ এটি। এ দাবি যে সঠিক নয়, তা কিছুদিনের মধ্যেই পরিষ্কার হবে। বিস্ময়কর, অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষ এ তত্পরতায় ‘আশার আলো’ দেখছে! বিশ্বাস অন্ধ হলেই এটা সম্ভব।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে
কোটিপতিদের দ্রুত বিকাশের একটা ধরন আছে। আশির দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশের নব্য
ধনিকদের যাত্রাপথ অনুসন্ধান করে তত্কালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় আমি একটি প্রবন্ধ (প্রচ্ছদ
কাহিনী) লিখেছিলাম। শিরোনাম ছিল—‘কোটিপতি: মেড ইন বাংলাদেশ’। তখন আমার অনুসন্ধানে বাংলাদেশের নব্য ধনিক শ্রেণীর গঠনের দ্বিতীয়
পর্বে ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পেয়েছিল। প্রথম
পর্বে ছিল লাইসেন্স, পারমিট, চোরাচালানি, মজুদদারি, রাষ্ট্রায়ত্ত
শিল্প-কারখানা, সম্পদ আত্মসাৎ ইত্যাদি। দ্বিতীয় পর্বে এর সঙ্গে যোগ হয় ব্যাংকঋণ ও
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মালিকানা লাভ। ব্যাংকঋণের সুবিধা বাড়ে, ঋণখেলাপিও
বৃদ্ধি পায়। ব্যবসা ও সরকারি ক্ষমতার মধ্যে যোগাযোগ ও চুক্তির নতুন বিন্যাস ঘটে।
নব্য ধনিক শ্রেণীর উপস্থিতি যত স্পষ্ট হতে থাকে, তত রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যক্তিমালিকানায়
যাওয়ার হার বাড়তে থাকে। আবার এ হস্তান্তরে ধনিক গোষ্ঠীর সম্পদ আরো বৃদ্ধি পায়।
আশির দশকের শুরুতেই ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয় এবং অনেক
ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ঋণখেলাপিদেরই নতুন ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের
মালিক হিসেবে দেখা যেতে থাকে। দেখা যায়,
একজন যত পরিমাণ ঋণখেলাপি, তার
একাংশ দিয়েই তারা অনায়াসে নতুন ব্যাংক খুলে বসে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো থেকে নামে-বেনামে ঋণ
গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক যোগাযোগ,
লেনদেন ব্যবস্থা সম্পদ কেন্দ্রীভবনের একটি
কার্যকর পথ হিসেবে দাঁড়াতে থাকে। রেহমান সোবহানের একাধিক লেখায় এ সময়কালের
বিশ্লেষণ আছে।
বাংলাদেশের নব্য বিত্তবান শ্রেণী অনুসন্ধানে
তাদের মধ্যে আমি যে প্রধান ধরন পাই,
তা বোঝাতে
‘লুম্পেন কোটিপতি’ পদ ব্যবহার করি প্রথম তখনই। লুম্পেন
কোটিপতি বলতে আমি বুঝিয়েছি এমন একটি শ্রেণী,
যারা নিজেদের বিত্ত অর্জনের জন্য উৎপাদনশীল পথের
চেয়ে দ্রুত মুনাফা অর্জনে অন্যান্য সহজ ও চোরাই পথ গ্রহণে বেশি আগ্রহী থাকে।
এগুলোর মধ্যে চোরাচালানি, মাদক ব্যবসা, ব্যাংকঋণ লোপাট,
জবরদখল,
জালিয়াতি ইত্যাদি অন্যতম। এজন্য সব অপরাধের পথ
তারা গ্রহণ করে নির্দ্বিধায়।
ততদিনে আন্তর্জাতিকভাবেও সমাজবিজ্ঞান চর্চায় ‘লুম্পেন বুর্জোয়া’ ধারণাটি পরিচিতি পেয়েছে। লুম্পেন বুর্জোয়া দুই ভাষার দুই শব্দ। লুম্পেন শব্দটি জার্মান। বুর্জোয়া শব্দটি ফরাসি, যা পুঁজিবাদের অভ্যুদয়ের কালে ব্যবহার হয় তত্কালীন মধ্যবিত্ত ও পরে ধনিক শ্রেণীকে বোঝাতে। পুঁজিপতি শ্রেণীর উৎপাদনবিচ্ছিন্ন লুটেরা ধরন বোঝাতে এ দুটো শব্দ প্রথম ব্যবহার করেন একজন অস্ট্রিয়ান লেখক, ১৯২৬ সালে। প্রথম ইংরেজি ভাষায় এর ব্যবহার করেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল ব্যারেন ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত পলিটিক্যাল ইকোনমি অব গ্রোথ গ্রন্থে। পরে এ শব্দবন্ধ বিশেষ পরিচিতি পায় জার্মান-মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংকের (১৯৭২) লুম্পেন বুর্জোয়া লুম্পেন ডেভেলপমেন্ট গ্রন্থের মাধ্যমে। তিনি এ গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার অধীন প্রান্তস্থ দেশগুলোয় পুঁজিবাদের বিকাশ আলোচনায় বিশেষভাবে লক্ষ করেন এমন একটি শ্রেণীর বিকাশ, যারা সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ঝুলে থাকে, নিজস্ব অর্থনীতির উৎপাদনশীল বিকাশের বদলে তারা যেকোনোভাবে অর্থবিত্ত অর্জনের পথ গ্রহণ করে, নিজেদের স্বার্থে বহুজাতিক পুঁজির আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট থাকে।