সৃজনশীলতার আতঙ্কে লাভবান কোচিং-গাইড ব্যবসায়ীরা

মো. ছোলজার রহমান

দেশে ২০১০ সালের পর থেকে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির পরীক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার মানে আমূল ও উন্নত পরিবর্তনের লক্ষ্যে পুস্তক প্রণয়ন এবং শিক্ষক-কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের কাজ হতে থাকে। ধারণা ও আশা করা হচ্ছিল শিক্ষার গুণগত মানে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হবে। ধাপে ধাপে একেকটি বিষয়কে সৃজনশীলতার আওতায় আনা হয়। লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় অনেক ব্যয়ও করা হয়। একই সঙ্গে জোরদার করা হয় বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ ও উপবৃত্তি প্রদান। সব উদ্যোগ, ব্যয় ও প্রচেষ্টার প্রয়োগে কতটুকু অগ্রগতি ও সাফল্য অর্জিত হলো, তা মাঠপর্যায়ে খতিয়ে দেখে প্রকল্প-পরবর্তী মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। আশা করি, প্রকল্পের উদ্যোক্তা ও পরিকল্পনাকারীরা প্রকল্প-পূর্ব, প্রকল্পকালীন ও প্রকল্প-পরবর্তী সফলতা ও লক্ষ্য অর্জনের তুলনামূলক মূল্যায়ন করবেন এবং একটি বাস্তবসম্মত রিপোর্ট জাতির সামনে উপস্থাপন করবেন। প্রকল্পটি দেশের শিক্ষায় গুণে ও মানে কতটুকু পরিবর্তন এনেছে বা অবদান রাখতে পেরেছে, তার বিবরণ ও গবেষণাগত মূল্যায়নও প্রয়োজন। অতীতের ভিত্তিমূলক ও মুখস্থনির্ভর শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে গুণগত মানের একটি তুলনামূলক চিত্র ও পার্থক্য প্রকাশ করা প্রয়োজন। সম্ভাবনা ও সাফল্য এবং ব্যয় ও সফলতার মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে দেশব্যাপী বাস্তবায়িত এসব বড় আকারের প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কতটুকু লাভ-লোকসান সম্পর্কিত, তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা না হলে আগামীতে প্রকল্প হাতে নেয়ার ক্ষেত্রেও সাবধান ও সতর্ক হওয়ার কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। ফলে এ বিপুল পরিমাণের জাতীয় রাজস্ব জাতিকে আশান্বিত বা হতাশার জন্য ব্যয় করা হলো কিনা, তা জানা সম্ভব হবে না। যেসব কর্ণধার, প্রথিতযশা ব্যক্তি, জাতীয় নেতা, শিক্ষাবিদ এমন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পরিকল্পনাকারী ও রূপকার, তাদের চিন্তাচেতনা কতটুকু বাস্তবসম্মত ও অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছে, তা খতিয়ে দেখেও তাদের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতিদান করা প্রয়োজন। প্রকল্প প্রণয়ন ও গ্রহণের সময় যেসব উদ্দেশ্য হাতে নেয়া হয়েছিল, সেসব উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক অর্জিত হয়েছে কিনা এবং তার কারণ উদ্ঘাটন ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে প্রকল্প-পরবর্তী সফলতা মূল্যায়নের জন্য কোনো একটি একক প্রতিষ্ঠান বা একক ব্যক্তিকে গবেষণার দায়িত্ব না দিয়ে একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন।

এখন আসা যাক মাঠপর্যায়ে শিক্ষার বর্তমান অবস্থা কোন পর্যায়ে রয়েছে। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখা যায় তৃতীয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত কোচিং অনেকটা অভ্যাসগত, প্রচলিত ও বাধ্যতামূলক। অভিভাবক ও সমাজের স্বাভাবিক ধারণা ও বিশ্বাস হলো, ভালোভাবে শিখতে হলে বা ফল ভালো করতে চাইলে প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিং বাধ্যতামূলক বা অবশ্যম্ভাবী। কোচিং এখন সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছে এবং পিএসসি/জেএসসি/এসএসসি/এইচএসসি পরীক্ষার আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের  জারিকৃত আদেশ থেকে বলা যায়, কোচিং এখন সরকারি ও জাতীয় স্বীকৃতি পেয়েছে। তৃতীয় শ্রেণী থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত গাইড বই বাজারে ব্যাপক বিক্রীত ও সমাদৃত। খুচরা বাজারে সব বইয়ের দোকানে বিভিন্ন কৌশলের নামে প্রকাশিত মূলত গাইড বই সারা বছর পাওয়া যায়। প্রকাশকদের জাদুকরী ক্ষমতার বদৌলতে বিভিন্ন বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন বিভিন্ন নামে প্রকাশিত এসব গাইড ব্যবহার করেন এবং শিক্ষার্থীদেরও ব্যবহার ও ক্রয়ে উৎসাহিত করেন। গাইড ব্যবসায়ীদের সাংগঠনিক ও বিপণন দক্ষতায় একেকটি উপজেলা ও জেলা একটি গাইডের একক বাজারেও পরিণত হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্টিলের আলমারি কিংবা কম্পিউটার সরবরাহ করে গাইড ব্যবসায় তারা সফল হন। আবার কিছু পরিমাণ টাকা অনুদান দিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার শিক্ষক সংগঠনের নেতাদের সম্মত করেও ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারেন। কিছুদিন আগেও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এসব গাইড নিষিদ্ধ জেনে প্রকাশ্যে ক্রয়, বহন ও ব্যবহারে সংকোচ বোধ করতেন। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু থাকার পরেও এটি নিষিদ্ধ ও অপ্রয়োজনীয় নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। শ্রেণীকক্ষে, পরীক্ষার হলে এসব গাইড নিয়ে বিচরণ এখন অতি পরিচিত ও স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আগেকার পরীক্ষা পদ্ধতি ছিল মুখস্থনির্ভর ও উগরানো ধরনের। শিক্ষার্থীরা পুস্তকের জ্ঞান মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় তা উগরিয়ে লিখত। নিজস্বতা ও বোধগম্যতা না থাকায় সেটি মারাত্মকভাবে সমালোচিত হয়ে বাদ পড়ে যায়। মুখস্থ নির্ভরতা কাটিয়ে শুধু শ্রেণীকক্ষের পাঠদানের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের বাড়িতে পড়ার চাপমুক্ত করার জন্যই সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়। এতে থাকবে না মুখস্থ করার দায়ভার, বাড়ির কাজের চাপ, প্রাইভেট-কোচিংয়ে পড়ার দায়বদ্ধতা। শিক্ষার্থীদের মূল পাঠ্যাংশ বোঝানো ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বোঝানোর মাধ্যমে তাদের জ্ঞানের ভিত মজবুত করে গড়ে তোলা হলে তারা তাদের জ্ঞানের প্রয়োগ করে সৃজনশীলতা দেখাতে পারবে। তাই সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি মূলত ভিত্তিমূলক শিক্ষা পদ্ধতির সফল প্রয়োগ। নিঃসন্দেহে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকবান্ধব। শিক্ষকরা পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে শুধু সমস্যা সমাধানের উপযোগী প্রশ্ন, সমস্যা, পরিস্থিতি ও কার্যক্রমে নিয়োজিত রেখে শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগ থেকেই সৃজনশীলতার বিকাশ মূল্যায়ন করবেন। এতে গাইড কিংবা প্রাইভেট-কোচিংয়ে পড়ার প্রয়োজন থাকার কথা নয়। আগেকার পদ্ধতিতে ভিত্তিমূলক শিক্ষাদানই প্রধান ছিল, কিন্তু পরীক্ষা পদ্ধতি ও মূল্যায়ন ছিল মুখস্থকেন্দ্রিক। সে সময় অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ওপর কিছু অনুশাসন প্রয়োগ করত, যার মধ্যে কিছু অনুশাসন ছিল কঠিন শাস্তি। এতে শিক্ষার্থীদের একটি বিরাট অংশ সুশৃঙ্খল ও বাধ্যগত হতো এবং একটি সামান্য অংশ স্কুল পালাত ও ঝরে পড়ত। বর্তমানে সৃজনশীল শিক্ষার প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে ভিত্তিমূলক জ্ঞান অর্জনের দিকে তেমন প্রাধান্য দেয়া হয় না। অন্যদিকে ২০১১ সাল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ওপর যাবতীয় অনুশাসন প্রয়োগ নিষিদ্ধ করার কারণে ভিত্তিমূলক জ্ঞান শেখানোও অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এখন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ শিক্ষকের আদেশ অমান্য করা এবং শিক্ষকের সঙ্গে বেয়াদবি ও অশালীন আচরণ করায়ও সাহসী ও অভ্যস্ত হয়েছে। বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য সরকারি বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত নবম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থী চলমান ক্লাসের মধ্যে অন্য শিক্ষার্থীদের সামনে শ্রেণীশিক্ষিকার বুকে হাত দিয়ে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, স্কুল কর্তৃপক্ষের কিছুই করার নেই। শিক্ষক নিয়োগে মেধাকে প্রাধান্য না দেয়া, নিয়োগে নানা রকম হস্তক্ষেপ, ক্ষমতা-মর্যাদা-মূল্যায়ন ইত্যাদি রকমফেরের কারণে কাঙ্ক্ষিত মানের দক্ষ শিক্ষকও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেখা যাচ্ছে না। নানা ধরনের শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ গড়ে ওঠায় সামান্য প্রশিক্ষণের সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষকের ব্যাপক সমাহারও দেখা যাচ্ছে।

সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতিতে এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর একটি অংশ উচ্চশিক্ষার জন্য মনোনীত হয়। অধ্যয়নরত শ্রেণীগুলোয় তাদের অধিকাংশের বাক্য গঠন ও বানান ভুল থেকে সহজেই অনুমান করা যায় দেশে এখন বাক্য গঠন ত্রুটি ও বানান ত্রুটি ধর্তব্য নয়। বাক্যে কোন পুরুষে ক্রিয়াপদের কী রূপ হয়, সেটি দেখলে মনে হয় দেশে এখন ভিত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক অভাব রয়েছে। সামান্যতম বিধিনিষেধ আরোপ না করে ঢালাওভাবে সনদপত্র প্রদান সহজ করা হলে সেটি অর্জনে শিক্ষা ও জ্ঞানার্জন গৌণ হয়ে পড়ে। ফলে বিকৃত রুচিবোধ, অপরাধ প্রবণতা, অনৈতিকতা, দায়িত্বহীনতা, কর্মবিমুখতা, মাদকাসক্তি, অলসতা, অশ্রদ্ধা, দুর্নীতিগ্রস্ততা ইত্যাদির ব্যাপক ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্র তৈরি হয়। কিছুদিন আগেও নৈতিক চরিত্র গঠন ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কাজটি সার্বক্ষণিকভাবে দেখাশোনা করতেন মা-বাবা, সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠ ও মুরব্বিরা; যা এখন প্রয়োগহীন ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। দেশে এখন ৮ ঘণ্টা শ্রম দেয়ার সক্ষমতাসম্পন্ন জনশক্তির ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে উন্নত ও সভ্য দেশগুলোর নাগরিকের চরিত্র, মূল্যবোধ, পরমত সহিষ্ণুতা, শৃঙ্খলা এবং আইন ও বিধি মেনে চলার অভ্যাস গড়ে ওঠার পেছনে জরিমানা অনুশাসনটি প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে।

 

মো. ছোলজার রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, সরকারি এমএম কলেজ, যশোর

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন