একটা কথা আমরা অনেক দিন থেকেই শুনে আসছি যে ব্যাংকে অর্থ নেই, বিশেষ করে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে। অর্থের ঘাটতি হওয়াকে অনেকে লিকুইডিটি শর্টেজ বা তারল্য সংকট বলে। তবে লিকুইডিটি শর্টেজ এবং লিকুইডিটি ক্রাইসিসের মধ্যে পার্থক্য আছে। কোনো ব্যাংক সাময়িকভাবে তারল্য ঘাটতিতে পড়তেই পারে। স্বল্পমেয়াদি ঘাটতি মেটানোর জন্য এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ করে। অথবা নিজের হিসাবে রক্ষিত ট্রেজারি বিলসও (টিবিএস) ভাঙাতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং সেক্টরে তারল্য ঘাটতি হলে সেটা কীভাবে মোকাবেলা করা যায়? সেটাও করা যায়। ওইক্ষেত্রে যে সংস্থা আমাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ব্যাংক, রিজার্ভ মুদ্রা বাজারে ছাড়ে, সেই সংস্থা বা ব্যাংককে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের অর্থনীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ মুদ্রা, যে মুদ্রা আমরা বাজারে প্রচলিত দেখি, তা নিয়ন্ত্রণের একচ্ছত্র অধিকার দেয়া হয়েছে। সেজন্য ব্যাংকিং সেক্টরে বা মুদ্রাবাজারে কোনো রকমের ঘাটতি দেখা দিলে সেই ঘাটতি মেটানোর জন্য এই ব্যাংককেই এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু রিজার্ভ মুদ্রা ছাড়ার ক্ষেত্রে একমাত্র আইন দ্বারা কর্তৃত্বপূর্ণ সংস্থা নয়, পুরো অর্থনীতিকে মুদ্রা ব্যবহার দ্বারা ভিজিয়ে (লুব্রিকেটিং) রাখার দায়িত্বও এই ব্যাংকের।
মুদ্রা কী কাজ করে? মুদ্রার
মূল কাজ লেনদেনকে সমাধা করা। তবে মুদ্রা নিজেও একটা সম্পদ। অনেক সময় লোকে মুদ্রাকে
বিকল্প সম্পদ হিসেবে ধারণ করে। কোনো কারণে যদি অর্থনীতিতে অনেক লোক একই সঙ্গে নগদ
অর্থকে ধারণ করতে থাকে, তাহলে তারল্য সংকট হতে পারে। তার পরও সেটা নির্ভর করবে কী ধরনের নগদ
ধারণ করছে, তার ওপর। এসব লোক যদি ঘরে নিয়ে নগদ অর্থ ধারণ করে বা সিস্টেম থেকে তুলে
নিয়ে অর্থকে অলস করে বসিয়ে রাখে তাহলে অর্থবাজারে অর্থের ঘাটতি দেখা দেবে। কোনো
কোনো অর্থনীতিতে এমন ঘটনা ঘটে,
বিশেষ করে কালো টাকার প্রবাহ যখন বেড়ে যায়, অথবা
লোকেরা যদি সংকট সম্পর্কে আগাম ধারণা করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে রিজার্ভ বা
উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মুদ্রা ছাড়ে,
সেটি প্রকৃত অর্থে অর্থনীতিতে কত মুদ্রার কাজ
করবে বা কত মুদ্রা সরবরাহ ঘটাবে,
তা নির্ভর করে অর্থনীতিতে মুদ্রা ব্যবহারের
ঘনত্ব ও গতির ওপর। সহজ কথায় বোঝার জন্য বলা যায় এভাবে যে এক মুদ্রা একই দিন তিনটা
লেনদেনেও ব্যবহার হতে পারে,
আবার চারটা লেনদেনেও ব্যবহার হতে পারে। যে
অর্থনীতি যত বেশি গতিশীল, সেই অর্থনীতিতে অর্থের ব্যবহার বেশি হয় এবং বলা চলে একটা নির্দিষ্ট
পরিমাণ ছাড়কৃত রিজার্ভ মুদ্রা থেকে অর্থনীতি অনেক বেশি মুদ্রা সরবরাহ পাবে। অর্থের
পুনঃপুন ব্যবহারকে বা এক অর্থ কতবার ব্যবহার হবে, সেই গতিকে অর্থশাস্ত্রে ভেলোসিটি অব
মানি বলে। সামগ্রিকভাবে মোট রিজার্ভ মুদ্রা অর্থনীতিতে এসে কত মুদ্রার কাজ করবে, তা
নির্ভর করে মুদ্রা ব্যবহারের ঘনত্ব বা গুণকের (মাল্টিপ্লায়ার) মানের
ওপর। মাল্টিপ্লায়ার ভ্যালু যদি বেশি হয়,
তাহলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ মুদ্রা
অর্থনীতিতে বেশি মুদ্রা সরবরাহ বাড়াবে। আর অর্থনীতি যদি ধীরে চলে, তাহলে
রিজার্ভ মুদ্রা থেকে উৎপাদিত মুদ্রার মাল্টিপ্লায়ার ভ্যালুও কমে যাবে। সেজন্যই
বাংলাদেশ ব্যাংককে সবসময় এটা হিসাবে নিতে হয় যে লেনদেনে বা সম্পদ ধারণে মুদ্রার
ব্যবহারের গতিপ্রকৃতিতে কী পরিবর্তন আসছে?
আজকে ব্যাংকিং সুবিধা ২৪ ঘণ্টা। ফলে মুদ্রার
ব্যবহারের গতিও বাড়ছে। আগে লোকদের খরচের জন্য নগদ অর্থ ঘরে তুলে রেখে দিতে হতো।
এখন ক্যাশ লেনদেন যেহেতু কমে যাচ্ছে,
সেজন্যই ক্যাশ ধারণের পরিমাণও অনেক কমে যাচ্ছে।
ব্যাংকিং সেক্টর থেকে অর্থ যখন বের হয়ে যায়,
তখন সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি কম মুদ্রা সরবরাহ
পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক চোখ-কান খোলা রেখে আমাদের মুদ্রা সরবরাহকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে রাখে। আবার
অর্থনীতি বড় হতে থাকলেও মোটের হিসাবে অর্থনীতিতে বেশি থেকে বেশি মুদ্রা ব্যবহার
হতে থাকবে। সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তার মুদ্রানীতি প্রণয়নের সময় কয়েকটা বিষয়কে
হিসাবে নেয়। তার মধ্যে আছে লেনদেনে অর্থ ব্যবহারের ঘনত্ব ও গতি, মানুষের
ক্যাশ ধারণের প্রবণতা, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এবং ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহের বিষয়টা। অন্যদিকে
আমাদের অর্থনীতির এক্সটার্নাল সেক্টর বা আমদানি-রফতানি এবং সেসঙ্গে বাংলাদেশী মুদ্রা
টাকার বিনিময় হারকেও হিসাবে নেয়া হয়। সুদের হার অর্থনীতির জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ
উপাদান। সুদের হার কম রাখতে হলে ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ যাতে বাড়ে, সেই
লক্ষ্যে মুদ্রা সরবরাহকে বাড়াতে হবে। আর এটা বাংলাদেশ ব্যাংক করতে পারে বা করে তার
ওপেন মার্কেট পলিসি অনুসরণ করে। মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক তার নিজস্ব
সুদের হার বা রেপো এবং রিভার্স রেপো রেটকে সামান্য কমাতে পারে। অন্যদিকে ব্যাংকের
এসএলআর অ্যান্ড সিআরআর (স্ট্যাচুটরি লিকুইডিটি রেশিও এবং ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও) কম
করলেও বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়বে। তাতে সুদের হার কমতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশ
ব্যাংক এডিআর (অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও)
বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতেও
বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বা অর্থপ্রবাহ বাড়বে। অর্থপ্রবাহ বাড়লে আশা করা যায় কথিত
তারল্য সংকট অনেকটাই হালকা হয়ে যাবে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ারবাজারকে নীতিগত
সমর্থন দেয়ার জন্য এডিআর বাড়তে দিয়েছে,
কিন্তু সেই প্রজ্ঞাপিত বাড়তি অর্থ কতটা
শেয়ারবাজারে যাবে, তা আরো অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে।
সব মিলিয়ে এটা বলা যায় যে বাংলাদেশ
ব্যাংকই একমাত্র ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংস্থা,
যেটা আমাদের অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ কমানো-বাড়ানোর কাজটি
করে। এ ব্যাংক তারল্য ঘাটতির কারণে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা, তা
তদারকি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে বর্তমানে মুদ্রাবাজারে কোনো রকম ঘাটতি নেই।
সেটা অংকের হিসাব হতে পারে। তবে বাস্তব অবস্থা যদি এমন হয় যে কোনো কারণে কিছু লোক
বড় অংকের অর্থ ব্যাংকিং বাজার থেকে তুলে নিয়ে ঘরের সিন্দুকে রেখে দিয়েছে, তাহলে
বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই অংক মিলবে না। সেজন্য মুদ্রানীতি থেকে ভালো ফল পেতে হলে
অর্থনীতিকে কালো লেনদেনমুক্ত রাখতে হবে। আমাদের অর্থনীতিতে ঋণখেলাপির সংস্কৃতি এখন
সর্বগ্রাসী হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেলাপি ঋণের ফাঁদ থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করতে না পারলে
সুদের হার যেমন কমানো যাবে না,
তেমনি মুদ্রা তথা অর্থ পাচারও বন্ধ হবে না। আর
সেই অবস্থায় একটা আদর্শ মুদ্রানীতিও কাঙ্ক্ষিত ফল দেবে না। কালো টাকার আকার বাড়তে
থাকলে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের বাজারও স্থিতিশীল থাকবে না। কারণ হলো কালো টাকার
ব্যবহার বেশি হয় অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে,
যা বৈদেশিক মুদ্রায় ঘটে। অন্য বিষয়টি হলো আমাদের
ব্যাংকিং ব্যবসার ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের মেয়াদি ঋণ দিয়ে ব্যবসা করার
প্রবণতা থেকে সরে আসতে হবে। আজকে যে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণের বইয়ে যোগ
হয়েছে, এর সিংহভাগই হলো টার্ম লোন বা মেয়াদি ঋণ। অন্য দেশে প্রজেক্ট অর্থায়নের
জন্য মেয়াদি ঋণের ব্যবসা থেকে ব্যাংক সরে এসেছে। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক ব্যাংক
প্রতিযোগিতা করে একই গ্রাহককে টার্ম লোনসহ বিভিন্ন ঋণ দিয়ে চলেছে। ফলে ওই সব
ব্যবসা বেশি ঋণের ফাঁদে আটকে গেছে। শেষ ফল হচ্ছে, এক সময়ের ভালো ব্যবসা শুধু বেশি ঋণ
গ্রহণের কারণে দেউলিয়া হয়ে পড়ছে,
অন্যদিকে ব্যাংকিং স্থিতিপত্রও কুঋণের বোঝায়
ভারী হচ্ছে।
আবু আহমেদ: মূলধনবাজার
বিশেষজ্ঞ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি
বিভাগের
অনারারি অধ্যাপক