রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কড়চা

তানভীর শাতিল

[গতকালের পর]

রাষ্ট্র কেবল আতঙ্কিত হয়ে যায় রোহিঙ্গাদের একত্র হতে দেখলেই! তাহলে এখন প্রশ্ন জাগে, রোহিঙ্গারা কি নিজেদের অধিকারের কথা এক হয়ে বলতে পারবে না? হয়তো উদ্বাস্তু ভিনদেশী হওয়ার কারণে বাংলাদেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকি খুঁজে পায়। কিন্তু যতদূর জানি, রোহিঙ্গাদের দাবিগুলো প্রথমবারের মতো কেবল ২০১৯ সালের ২৫ আগস্টদোয়া অনুষ্ঠানে বা গণজমায়েতেই উচ্চারিত হয়নি। তারা বিভিন্ন সময় ক্ষুদ্র পরিসরে বলার চেষ্টা করেছে, এবার তারা বিশাল জমায়েতে জানান দিয়েছে। এ জমায়েতে তারা বাংলাদেশের প্রতি হুমকিস্বরূপ কোনো বাক্য বলেছে বলে আমার জানা নেই। যতদূর জেনেছি, তারা একটা অহিংস দাবির কথা বলেছে বিশ্ববাসীর কাছে, তারা গান্ধী, ম্যান্ডেলার আদর্শের কথা বলেছে। সরকারি বয়ানে আস্থা রেখে ধরে নিলাম, এ জমায়েত জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকি হতে পারে। প্রশ্ন হলো, এটা কীভাবে সম্ভব হলো? যেখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় সরকারি প্রশাসন ও গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। ক্যাম্পে ক্যাম্পে ইনচার্জ বা সিআইসিদের পাকা দালান করা অফিস আছে। তারা ক্যাম্পের শৃঙ্খলা ও শান্তি বিধানসহ সব সেক্টরের তদারকি করেন। তাদের উপস্থিতিতে এমন গণজমায়েত সবার অগোচরে হুট করে হয়েছে তা ভাবার কোনো যৌক্তিকতা নেই। যেসব রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের জন্য প্রত্যাবাসন কর্তৃপক্ষের কাছে সাক্ষাত্কার দিচ্ছেন, তারা কেউই শর্তহীন প্রত্যাবাসনের কথা বলছেন না, তারা শর্তারোপকৃত প্রত্যাবাসনের কথা বলছেন। আর এটাই স্বাভাবিক নয় কি?

আর রোহিঙ্গা গণজমায়েতে আতঙ্কিত হয়ে যাওয়ার খবরা-খবর ও সরকারের প্রতিক্রিয়াগুলো একটা বার্তা দেয়, মানবতার ধারক বাংলাদেশ সরকারের কাছেও রোহিঙ্গারা নেতিবাচক একটা চরিত্রে পরিণত হচ্ছে, যা দিন শেষে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়ের সঙ্গে এক ধরনের স্টেরিওটাইপ বা গত্বাঁধা কিছু নেতিবাচক ধারণা জুড়ে দিয়েআলাদাকরণ তৈরির একটা প্রক্রিয়া মনে হয়। আর সামগ্রিক বিষয়টা আমার কাছে ধরা দেয় জাতিরাষ্ট্রের যে কাঠামো তার ভেতরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোয় এক অমোঘ মিল রয়েছে, আর তার ভেতর থেকে এ ধরনের শরণার্থী সমস্যা সমাধান অত্যন্ত দুরূহ। মানবিকতার কোনো দেশ-কাল-পাত্র থাকাটা আমার কাছে বরাবরই অযৌক্তিক লাগে। মানবিকতা হওয়ার কথা ধর্ম, জাতি, রাষ্ট্র সব কাঠামোর ঊর্ধ্বের এক বিষয়। উন্নয়ন ও মানবিক সংস্থাকেন্দ্রিক জাতিরাষ্ট্রীয় বৈশ্বিক কাঠামোর যেগভর্নমেন্টালিটি বাশাসনমানসিকতা’, তা ক্ষমতার সম্পর্কের তলানিতে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তার আত্মপরিচয়ে বলীয়ান হওয়ার কোনো রাস্তা আপাতত দেখাতে পারছে না। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আরেকটা বিষয় রোহিঙ্গারা প্রায়ই তোলে, তা হলো এর আগেও এমন হয়েছে যে মিয়ানমার সরকার তাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেছে এবং আবার তাদের বিতাড়িত করেছে। তাই কোনো নাগরিক অধিকার পাওয়া ব্যতীত কেবল আন্তর্জাতিক চাপে মৌখিক আশ্বাসে ফিরে যাওয়া কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। তাদের বয়ানে, ‘মিয়ানমার সরকার বেইমান, মগদের (বৌদ্ধ মিয়ানমার সরকারের) কোনো বুক-পিঠ নেই। তারা আবার বেইমানি করবে। তাই ন্যাশনালিটি না নিয়ে আমরা আর ফিরব না। তাই মিয়ানমার সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের যে আস্থার ঘাটতি, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের মনোযোগী হতে হবে এবং এ বিষয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণপূর্বক প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও তাদের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া প্রত্যাবাসন সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান হবে না।

সব শেষে আপাতদৃষ্টিতে ২৫ আগস্টের রোহিঙ্গা জমায়েতকে খারাপভাবে দেখা হলেও এর মাঝেও কী কী সম্ভাবনা আছে যা কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গাদের সুষ্ঠু, সুন্দর ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা যায়, তা ভাবা অতীব জরুরি। রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের রাজনৈতিক কাঠামোগত আচরণের গণ্ডির বাইরে গিয়ে মানবিকতার উদারতা দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যাকে বোঝাটা জরুরি। তা না হলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। রোহিঙ্গাদের ওপর জোর খাটালে আবার মানবিক বিপর্যয় হবে কিংবা কোনো কারণে বা বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপরও যদি বিশ্বাস উঠে যায়, তখন তাদেরজঙ্গিবাদ বাসাংঘর্ষিকতার দিকে ঝোঁক বাড়তে পারে। আর এ বিষয়ে অনেকেই ওত পেতে বসে আছে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের আশায়, সেটা ভুললে চলবে না। ফলে এগুলো নিয়ে আরো নিবিড় গবেষণা ও আলোচনা হওয়া জরুরি। [শেষ]

 

তানভীর শাতিল: উন্নয়ন গবেষক, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন