আরইবিতে ঘুষ-বাণিজ্য

গ্রাহক হয়রানি বন্ধে শক্ত পদক্ষেপ নেয়া হোক

ঘুষ ও দুর্নীতিতে যে কটি খাত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায় শীর্ষে রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) অন্যতম। ঘুষ ছাড়া কোনো সেবাই মেলে না বিআরইবিতে। সংযোগ প্রদান থেকে শুরু করে খুঁটি স্থাপন, মিটার বসানো বা পুনঃস্থাপন সবক্ষেত্রেই ঘুষের ছড়াছড়ি। আর বিষয়টি ওপেন সিক্রেট সর্বত্র। ভুতুড়ে বিল তৈরি ও গ্রাহক থেকে জোর করে অর্থ আদায়ের অভিযোগও রয়েছে অনেক। অধিকাংশেরই কোনো তদন্ত হয়নি। যে কয়েকটির তদন্তে কমিটি গঠন হয়েছে, তারও অনেকগুলো আলোর মুখ দেখেনি। এ অবস্থায় গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরইবিতে ঘুষ-বাণিজ্যে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। এসব কারণে মাঝে মধ্যেই আরইবি জনগণ দ্বারা আক্রান্ত হয়। পল্লী বিদ্যুতের সেবা প্রদানে ঘুষ-বাণিজ্যের কাজটি সহজ করে দিয়েছে স্থানীয় রাজনীতিক ও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকা দালালরা। তাদের দৌরাত্ম্য কমাতে সংশ্লিষ্টরা শুধু প্রতিশ্রুতিই দিয়ে যাচ্ছেন। পরিস্থিতির অবনতি ছাড়া উন্নতি হয়নি। লোডশেডিং ও লো-ভোল্টেজের অভিযোগ বহু পুরনো হলেও দৃশ্যমান উদ্যোগ নেয়া হয়নি এ সমস্যার সমাধানে। ট্রান্সফরমার নষ্ট হলেও গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা হয় মোটা অংকের অর্থ। দুর্নীতি বন্ধে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের নির্দেশনাও কাজে আসেনি। ঘুষ ও দুর্নীতির কারণে বিআরইবির ওপর থেকে মানুষের আস্থা বিনষ্ট হয়েছে। তারা এখন আর বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে চাচ্ছে না। এ কারণে বিআরইবি আলোর ফেরিওয়ালা প্রচারণায় নেমেছে। তাতেও সাড়া মিলছে না।

অপ্রতিহত দুর্নীতির কারণেই দেশের বিভিন্ন স্থানে জনরোষের শিকার হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ক্ষতি হচ্ছে মূল্যবান জাতীয় সম্পদের। বস্তুত দুর্নীতিই যে প্রতিষ্ঠানের নীতি হয়ে পড়ে, সে প্রতিষ্ঠানের কাজ অকাজে পরিণত হবে এটাই স্বাভাবিক। মানুষ সেখান থেকে উপকৃত তো হয়-ই না, বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে এমনটিই ঘটছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে। এ অবস্থায় এর বর্তমান চেয়ারম্যান পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন। দুর্নীতি বন্ধে সেমিনার ডেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শপথও করিয়েছেন তিনি। তবে এ পদক্ষেপে কতটা সুফল মিলবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। যাদের কারণে মানুষ বিদ্যুতের সংযোগ পেতে হয়রানির শিকার হয়েছে, গ্রাহকদের অতিরিক্ত বিল দিতে হয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি না দেয়া পর্যন্ত পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। আমরা আশা করি, পল্লী বিদ্যুতের দুর্নীতিবাজদের শুধু শপথ করিয়ে ছেড়ে দেয়া নয়, দুর্নীতির জন্য উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা হবে। তাহলেই প্রতিষ্ঠানটি জনরোষ থেকে বাঁচবে।

আমরা দুর্নীতিতে এমনভাবে নিমজ্জিত হয়েছি যে ইচ্ছা করলেই বেরিয়ে আসতে পারি না। বাংলাদেশের বেশির ভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠানে চলে অনিয়ম ও দুর্নীতি। একদিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যাশিত লভ্যাংশ থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে ভুক্তভোগী জনগণ সরকার ও প্রশাসনের ওপর বিরক্ত হয় শুধু গ্রাহকদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর অসহযোগিতার কারণে।

বাংলাদেশে বিদ্যুতের উন্নতি হয়েছে নিঃসন্দেহে। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে অনেকটা সফলতা দেখাতে পেরেছে। কিন্তু সরকারের এ সফলতা ম্লান হয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে। এ খাতে প্রথম থেকে জনবান্ধব উদ্যোগ আমরা লক্ষ করিনি। সেখানে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম ও দুর্নীতির ব্যাপারটি একটি বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। কোনো কিছু নিয়ে গ্রাহকের সঙ্গে বিদ্যুৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর খিটমিট আচরণ হলে অথবা কোনো গ্রাহক বাধ্য হয়ে যদি কারো বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেন, তখন কোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে ওই গ্রাহকের বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। লাইন একবার বিচ্ছিন্ন করা হলে তা সহজে পুনঃসংযোগ দেয়া হয় না। ফলে এ ভয়ে গ্রাহকরা সব দুর্নীতি হজম করে হলেও বিদ্যুৎ বিভাগের লোকদের বাধ্য হয়ে তোষণ করে আসছে।

গত পাঁচ বছরে সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়টি প্রশংসনীয়। কিন্তু উৎপাদনের সঙ্গে বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়। সেচের পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে সংশয় থেকেই যাবে, যদি না বিতরণ ব্যবস্থায় উন্নয়ন ঘটানো যায়। বিষয়টিতে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়কে প্রথম থেকেই নজর দেয়া উচিত ছিল। প্রথম থেকেই যদি এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পরিকল্পিত উদ্যোগ নেয়া হতো, তাহলে বিতরণে সমস্যা দেখা দিত না। যত দ্রুত সম্ভব তাদের এ সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করতে হবে। বিতরণ লাইনের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও যান্ত্রিক ত্রুটি দ্রুতগতিতে দূর করে বিতরণ ব্যবস্থা উৎপাদন ক্ষমতা ও চাহিদার সঙ্গে সমন্বিত করতে হবে।

দেশের সর্বত্রই প্রায় একই অবস্থা। অনেক স্থানে গ্রাহকরা টাকা দিয়েও ভয়ে প্রকাশ করেন না, পাছে বিদ্যুৎ না পান। অনেক এলাকার গ্রাহক রাজনীতিকদের কাছে ধরনা দেন বিদ্যুৎ সরবরাহ চালুর জন্য। কয়েকটি এলাকার গ্রাহকরা বলেছেন, দেশের সব মানুষকে বিদ্যুৎ দেয়ার জন্য যে প্রশংসা সরকারের প্রাপ্য, তা চাঁদাবাজি-দুর্নীতির কারণে পাচ্ছে না। অথচ চাঁদাবাজরা সরকারি দলেরই লোক। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেয়ার যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তা বাস্তবায়নের অন্যতম কাণ্ডারি আরইবি। এজন্য সংস্থাটি হাজার হাজার কোটি টাকার একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু জনগণ সেবা পেতে পদে পদে যেভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে, তাতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। যারা বিদ্যুৎ বিভাগে লুটপাট আর দুর্নীতি করছে, তারা যে দেশ ও দলের শুভাকাঙ্ক্ষী নয়, তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। তাই তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে বড় বড় কর্মকর্তা, রাঘববোয়াল ও প্রতিটি এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সাইট ইঞ্জিনিয়ারদের কঠিনভাবে নজরদারিতে রাখা, প্রয়োজনে তাদের সম্পত্তির হিসাব নেয়া এবং তাদের জবাবদিহিতা বাধ্যতামূলক করা। বিদ্যুৎ বিভাগের অনিয়ম আর দুর্নীতির লাগামহীন কালো ঘোড়া থামাতে না পারলে এর চরম মূল্য দিতে হবে। কারণ বিদ্যুৎ মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত। এখানে অনিয়ম আর দুর্নীতি হলে জনঅসন্তোষ বাড়বে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন