রেলস্টেশনের সেবার মানে উন্নতি নেই

পর্যাপ্ত অবকাঠামো নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা উন্নত হোক

টিকিটের মূল্য অস্বাভাবিক বাড়ার পরও রেলওয়ে ও স্টেশনে সেবার মান বাড়েনি। এরই মধ্যে যাত্রীর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। সেক্ষেত্রে রেলওয়েতে গুণগত মান একটুও বাড়তে দেখা যায়নি। অধিকাংশ রেলওয়ে স্টেশনের চারদিক সংরক্ষিত না থাকার কারণে হকার, ভিক্ষুক, ফেরিওয়ালা, ছিঁচকে চোর ও হেরোইনসেবীদের দৌরাত্ম্য কমেনি। নিরাপত্তার দিক থেকে রেলস্টেশনগুলোর সামগ্রিক চিত্র শূন্য। স্টেশনে রেলওয়ে পুলিশের ভূমিকা নীরব ও নির্বিকার। তবে আজেবাজে লোকজন ও টোকাইদের ঘোরাঘুরিতে গোটা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের পরিবেশ নষ্ট হতে চলেছে। একটি সংঘবদ্ধ দল কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের টিকিট বিক্রি জিম্মি করে রেখেছে। লম্বা লাইন ধরে টিকিট কিনতে গেলে ঠিক কাউন্টারের সামনে যাওয়ামাত্র বলা হয়ে থাকে টিকিট নেই। অথচ দালালদের কাছে সব ট্রেনের টিকিট অতিরিক্ত টাকায় সহজেই পাওয়া যায়। স্টেশনমাস্টার কাউন্টারের লোকদের কষ্ট কখনো দেখতে আসেন না। নোংরা, অপরিচ্ছন্ন ও দুর্গন্ধে ভরপুর গোটা স্টেশন।

রেলে কয়েক বছরে যে পরিমাণ বিনিয়োগ ও প্রকল্প নেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নের মতো দক্ষ কর্মকর্তার অভাব রয়েছে। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, যাত্রী সুবিধা বা আয়বর্ধক প্রকল্প না নিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ কেনাকাটার প্রকল্প নেয়া। এক্ষেত্রে রাজনীতিক, ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের ব্যক্তিস্বার্থ কাজ করেছে। প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে পরিকল্পনার যে অভাব রয়েছে, তা রেলওয়ের যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের চিত্র থেকেই স্পষ্ট। রেলপথ বাঁচাতে ও বাংলাদেশ রেলওয়েকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনায় ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বররেলপথ মন্ত্রণালয় নামে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। কিন্তু আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন, রেল বাজেট বাড়লেও একের পর এক স্টেশন বন্ধ, মেয়াদোত্তীর্ণ রোলিং স্টক, জরাজীর্ণ রেল কারখানা, লোকবল সংকট, সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছতে না পারা, টিকিট পেতে ভোগান্তি, ছেঁড়া-নোংরা আসন, যাত্রীদের নিম্নমানের খাবার পরিবেশন আর সব মিলিয়ে অত্যন্ত নিম্নমানের যাত্রীসেবাএ অবস্থা থেকে এখনো বের হতে পারছে না রেলওয়ে। রেললাইন, স্টেশন, রেল-কারখানা এবং ভূমিসহ বাংলাদেশ রেলওয়ের অবকাঠামো এখনো দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম। কিন্তু বর্তমানে ৩ হাজার ৩০০ কিলোমিটারের বেশি রেলপথের অধিকাংশের অবস্থাই শোচনীয়। রেলপথে মোট ৩ হাজার ৬টি রেলসেতুর বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ ও নড়বড়ে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, রেলওয়েতে বিগত সময়ে বিনিয়োগ বাড়লেও তা মোটেই সুপরিকল্পিত হয়নি। কেননা রেলপথে যাত্রী বাড়ানো, আয় বাড়ানো ও লাভজনক করাতিন বিবেচনা প্রকল্পগুলোয় গুরুত্ব পায়নি। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা ও সংশ্লিষ্টদের ব্যবসায়িক স্বার্থকেই হয়তো বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। রেলওয়ে স্টেশনে কোনো শৃঙ্খলা নেই। নেই কোনো ন্যূনতম নিরাপত্তার চিহ্ন। স্টেশনের অভ্যন্তরে বহিরাগতদের আসা-যাওয়া বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেই। এক্ষেত্রে রেলওয়ে পুলিশের অবহেলা-উদাসীনতা লক্ষণীয়। এমতাবস্থায় ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনটি আধুনিকীকরণ, দুর্ভোগ লাঘবের জন্য কাউন্টার বাড়ানো, অপরিচ্ছন্নতা দূর করা, হেরোইনসেবী, বহিরাগত, হকারও টিকিট কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। মহিলা-পুরুষ আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি কলকাতাগামী ট্রেনের টিকিট কাউন্টার আরো বাড়ানো দরকার। রেলওয়ের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ দূর করতে হবে। টিকিট কাউন্টার ও টিকিট ব্ল্যাকারদের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। পর্যাপ্ত ট্রেন ও ট্রেনের টিকিট চাই। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেলওয়ের সেবার মান বাড়ানো খুবই জরুরি।

প্রতিটি রেলওয়ে স্টেশনকে সংস্কার করে যাত্রীদের জন্য স্বস্তিদায়ক ও মনোরম স্থানে পরিণত করতে হবে। উন্নত শৌচাগার এর পূর্বশর্ত হওয়া আবশ্যক। ইউরোপ কিংবা এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর বড় শহরেসেন্ট্রাল বা কেন্দ্রীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা রেলভিত্তিক হয়ে থাকে এবং বাস সার্ভিস তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশের সুবিশাল হাওড়া স্টেশন কিংবা মুম্বাইয়ের ভিক্টোরিয়া টার্মিনালের যে ঐতিহ্য ও সেবার মান, তার তুলনায় বাংলাদেশের বৃহৎ রেলস্টেশন কমলাপুরই অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এটি বড়ই আশ্চর্যের বিষয়, দেশের সর্ববৃহৎ রেলস্টেশনে অনেক সুযোগ-সুবিধা না-ও থাকতে পারে, কিন্তু শৌচাগার সেবার বেহাল দশা মেনে নেয়া যায় না। স্টেশনের ভেতরে ও বাইরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাধারণ যাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত শৌচাগারের ব্যবস্থা, তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং যাত্রীদের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। নারী ও পুরুষ উভয়েই যেন নির্বিঘ্নে এ শৌচাগার ব্যবহার করতে পারে, তার সুব্যবস্থা করতে হবে। এটি যেকোনো টার্মিনাল গড়ে ওঠার একটি ন্যূনতম শর্ত।

একটি রেলওয়ে স্টেশনে ন্যূনতম কী কী সেবা জোগানো হবে, তার একটি সর্বজন তালিকা বা সিটিজেন চার্টার তৈরি করা আবশ্যক। সে অনুযায়ী সেবা না মিললে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধানও সংযোজন করতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যাত্রীর তুলনায় স্বল্প অবকাঠামোর কারণে মানসম্পন্ন সেবা জোগানো কঠিন হয়ে পড়ছে। স্বল্প অবকাঠামোর আবার অধিকাংশই রেলওয়ে কর্মচারীরা নানা বাহানায় দখল করে রাখে। স্টেশনে যাত্রী হাঁটার জায়গা না থাকলেও দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ঠিকই। আশার কথা হলো, সরকার নতুন কিছু স্টেশন নির্মাণ করছে যাত্রীসেবা বাড়াতে। কিন্তু সেগুলোও মানসম্পন্ন সেবা দিতে পারছে না লোকবল সংকটের কারণে। এক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সেবার মান বাড়ানো যায় কিনা, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষার কাজ কোনো একটি কোম্পানিকে দিয়ে তদারকির মাধ্যমে উন্নত সেবা নিশ্চিত করা যায় সহজেই। বিশ্রামাগার বা টয়লেট ব্যবস্থাপনাও উন্নত করা যায় একইভাবে। কিন্তু সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে অবকাঠামো। যাত্রী অনুপাতে অবকাঠামো খুবই অপ্রতুল। নতুন স্টেশনগুলোও আগামী ৫০ বা ১০০ বছরের কথা চিন্তায় নিয়ে করা হচ্ছে না। ফলে স্টেশনগুলোয় যাত্রীসেবার মান বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়ছে। শুধু আদেশ দিলেই হবে না, সেবা জোগানোর মতো অবকাঠামোও নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনাও উন্নত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন